শনিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন ইমরান

ভাগ্য পরীক্ষা আজ । পাকিস্তানে এরপর কী

প্রতিদিন ডেস্ক

সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন ইমরান

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছেন, ‘রায়ে (সুপ্রিম কোর্টের রায়) আমি দুঃখ পেয়েছি; কিন্তু তা মেনে নিয়েছি। আস্থা ভোট এড়িয়ে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার কৌশল নিয়েছিলেন ইমরান।  সুপ্রিম কোর্ট তা অবৈধ ঘোষণা করে শনিবার (আজ) জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসিয়ে আস্থা ভোটের নিষ্পত্তি করতে বলেছে। স্থানীয় সময় গত রাত সাড়ে ৯টায় ভাষণে ইমরান সবিস্তারে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেছেন দেশবাসীর সামনে। তিনি বলেন, ডেপুটি স্পিকার সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদের আলোকে পার্লামেন্ট অধিবেশন মুলতবি এবং অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল করেছিলেন। এ অনাস্থা প্রস্তাবে বিদেশি হস্তক্ষেপ ছিল। আমি চেয়েছিলাম সুপ্রিম কোর্ট অন্তত এ বিষয়টিতে নজর দেবে। অন্য একটি দেশ চক্রান্ত করে পাকিস্তান সরকারের পতন ঘটাতে চায়- এটি একটি গুরুতর অভিযোগ। তাই এ বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট অন্তত তদন্ত করে দেখবে এমনটিই আশা করেছিলেন বলে জানিয়েছেন ইমরান।

পাকিস্তানের রাজনীতি আবারও নতুন এক ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হতে চলেছে। কারণ সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী আজ সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা। অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে এ অধিবেশনেই প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানকে অনাস্থা ভোটে হেরে বিদায় নিতে হবে। তবে শেষ পর্যন্ত কী ঘটে তা নিয়ে নানা মহলে রয়েছে কৌতূহল। সবাই অপেক্ষা করছেন নাটকীয়তা কোন দিকে মোড় নেয় এবং আবারও দেশটি অসাংবিধানিক বা অস্থিতিশীল রাজনীতির পথে ধাবিত হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য। দেশটির প্রভাবশালী দৈনিক ডনের খবর অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব খারিজের সিদ্ধান্ত বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট। সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী আজ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য জাতীয় পরিষদের স্পিকার। ৩ এপ্রিলের আলোচ্যসূচির সঙ্গে মিল রেখে সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যেই এ অধিবেশন শুরু করতে হবে। ধারণা করা হচ্ছে, অধিবেশন শুরু হওয়ার পর ভোটাভুটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্পিকার বৈঠক স্থগিত করতে পারবেন না। বিশেষজ্ঞরা এও বলছেন, স্পিকার আসাদ কায়সারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব থাকায় তিনি হয়তো আজকের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করতে পারবেন না। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী আজ অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে ইমরান খানই হবেন অনাস্থা ভোটে বিদায় নেওয়া পাকিস্তানের প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী। এর আগে দুই প্রধানমন্ত্রী অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হয়েও টিকে যান। পাকিস্তানে কোনো প্রধানমন্ত্রীই তাঁদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। তবে ইমরানকে বিদায় নিতে হতে পারে পার্লামেন্টে আনা অনাস্থা ভোটে। এদিকে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট পুনর্বহাল করতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, দেশের জন্য তিনি ‘শেষ বল পর্যন্ত’ লড়াই চালিয়ে যাবেন। বৃহস্পতিবার রাতেই এক টুইটে তিনি এ কথা বলেন। জানা গেছে, গতকাল মন্ত্রিসভার সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন ইমরান খান। বৈঠকে আজকের অধিবেশনের কৌশল ঠিক করা হয়। তকে কী কৌশল সে সম্পর্কে স্পষ্টত কিছু জানা যায়নি। এ ছাড়া এদিনই ইমরান খান নিজ দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) পার্লামেন্টারি কমিটির সদস্যদের সঙ্গেও পৃথক বৈঠক করেছেন। এখানেও রাজনৈতিক কৌশল চূড়ান্ত করা হয়।

গণমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হচ্ছে, ইমরান খান চাইছেন তাঁর সরকার ও সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন আগাম নির্বাচন দেওয়া হোক। আর বিরোধীরা চাইছেন অনাস্থা ভোটে ইমরান সরকারের পতন হোক এবং বর্তমান সংসদের মাধ্যমে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হোক, নতুন সরকার গঠিত হোক। মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত পার্লামেন্ট বহাল থাকুক। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে আজকের অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের বিদায় নিশ্চিত ধরে নিয়ে সম্ভাব্য নতুন ফেডারেল সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেছে বিরোধী জোট। তারা নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সভাপতি শাহবাজ শরিফের নামও ঠিক করে ফেলেছে। বিরোধী জোটের সূত্রগুলোর বরাত দিয়ে দি এক্সপ্রেস ট্রিবিউন বলছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী জাতীয় সরকারের মতো নতুন ফেডারেল সরকার গঠন করা হবে। এতে আনুপাতিক হারে শরিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকবে। নতুন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এর মেয়াদ ছয় মাস অথবা এক বছর রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এ মেয়াদের মধ্যে নির্বাচনী সংস্কার ও জবাবদিহি-সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলো পাস করার পরিকল্পনা রয়েছে। খবরে আরও বলা হয়, জাতীয় পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফ বিরোধী জোটের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী। শপথ নেওয়ার পর তিনি সম্ভাব্য সরকারের অগ্রাধিকারগুলো ঘোষণা করবেন। এসব অগ্রাধিকারের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও রুপির দরপতন ঠেকানোর মতো অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন থাকবে। যুদ্ধ নয়, শান্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সব দেশের সঙ্গে সমানভাবে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্রনীতিতেও পরিবর্তন আনবে সম্ভাব্য নতুন সরকার। নিপীড়নের উদ্দেশ্যে বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলোর কার্যক্রম বন্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া নতুন প্রেসিডেন্ট এবং চারটি প্রদেশে নতুন গভর্নর নিয়োগে সাংবিধানিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ইমরান খান সরকারের সব সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা ও পরিবর্তন করা হতে পারে বলেও সূত্রগুলো জানিয়েছেন। বলা হচ্ছে, সরকার গঠনের পরপরই পরামর্শ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারকে দেশে ফেরানোর কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। গণমাধ্যমগুলো বলছে, ইমরানকে হটিয়ে বিরোধীরা যদি সরকার গঠন করে সে ক্ষেত্রে ইমরান তাঁর গণমুখী কৌশল অবলম্বন করে বিরোধিতায় নামবেন এবং আন্দোলন সংগঠিত করার চেষ্টা করবেন, এটা অবধারিত। এ অবস্থায় সব পক্ষকে নিয়ে একটা সর্বসম্মত নির্বাচন অনুষ্ঠান বেশ কঠিন হয়ে পড়বে। অবশ্য অনেক কিছুই নির্ভর করছে দেশটির সেনাবাহিনী কী ভূমিকা নেবে তার ওপর। রাজনৈতিক সংকট যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র হয়ে ওঠে, তবে অতীতের মতো আরও একবার পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারে সেনাবাহিনী। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের পেছনে রয়েছে বিদেশি হস্তক্ষেপ। তার পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ভিতরেও অসন্তোষকে কেউ কেউ দায়ী মনে করেন। মুদ্রাস্ফীতিসহ অর্থনৈতিক সংকটও বিরোধী জোটকে সুযোগ করে দিয়েছে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব তুলতে। অন্যদিকে নওয়াজ শরিফের পরিবারের প্রতি সৌদি সমর্থনের বিষয়টিও বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৌদি আরব ও আমেরিকা পাক সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ের অর্থনৈতিক সংকট, বৈদেশিক ঋণের বোঝা, রুপির মূল্যমান কমে যাওয়া এবং দুর্নীতির ব্যাপকতা ইমরান খানের জন্য নতুন সংকটের জন্ম দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক জটিলতা। চীনের প্রতি অধিক নির্ভরতা, সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, তালেবানদের মদদ দিয়ে মার্কিন বাহিনীকে আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে বাধ্য করা, ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহর অগ্রগতির জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠার কারণে ইমরান খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর গাত্রদাহের কারণ হয়ে ওঠেন। উইওন বার্তা সংস্থা মস্কো থেকে পরিবেশিত এক খবরে জানিয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির জন্য ইমরানকে শায়েস্তা করতে চাইছে আমেরিকা। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের প্রস্তুতি পর্বে ফেব্রুয়ারিতে ইমরান খান মস্কো সফর করেন। আমেরিকার পক্ষ থেকে এ নিয়ে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয় বলে ইমরান নিজেই দাবি করেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, আমেরিকা পাকিস্তানের রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ করছে।

সর্বশেষ খবর