রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানির অর্থ পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা

রুহুল আমিন রাসেল

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এখন উত্তপ্ত বিশ্ব। রাশিয়ার এ সামরিক অভিযানের জবাবে ইউক্রেনের মিত্ররা দেশটির বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর ওপরও এ নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার ওপর সুইফট কোড নিষেধাজ্ঞার কারণে সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত। ফলে রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানির অর্থ পাচ্ছেন না বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। সংকট উত্তরণে রপ্তানির বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবর্তনের সময় বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশ থেকে হিমায়িত চিংড়ি, মাছ ও পোশাকপণ্য রপ্তানির বিপরীতে অর্থ পাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তাঁর মতে, ‘যুদ্ধ ও সুইফট কোড নিষেধাজ্ঞার কারণে কয়েক ধরনের সমস্যা হচ্ছে। কিছু পণ্য শিপমেন্ট হয়ে গেছে, কিছু পণ্য পথে আছে আর কিছু পৌঁছে গেছে। ক্রেতারা পণ্য নিচ্ছেন না। ফলে পেমেন্ট অনিশ্চিত হয়ে গেছে। আর যে অর্ডার এখন আছে তার ভবিষ্যৎ কী তা-ও নিশ্চিত নয়। এ সংকট থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিসহায়তা চেয়েছি।’ এর আগে রাশিয়ায় হিমায়িত চিংড়ি ও মাছ রপ্তানির বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবর্তনের সময় বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরকে চিঠি দিয়েছেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন। একই বিষয়ে ২০ মার্চ এফবিসিসিআই সভাপতিকে চিঠি দেন বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি মো. আমিন উল্লাহ।

একই বিষয়ে লেখা পৃথক দুই চিঠিতে বলা হয়- বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা চলে আসছে। প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানিকারক কারখানা বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হিমায়িত চিংড়ি ও মাছ রাশিয়ায় রপ্তানি করে। উল্লেখ্য, ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় হিমায়িত চিংড়ি ও মাছ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত হিমায়িত চিংড়ি ও মাছ রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর এবং তাদের ব্যাংকগুলোর ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় রপ্তানি হওয়া পণ্যের বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবর্তনে জটিলতা দেখা দিয়েছে।

চিঠি দুটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তিনটি অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়- এক. ইএক্সপির বিপরীতে রপ্তানিমূল্য প্রত্যাবর্তনের যে ১২০ দিনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সাম্প্রতিক রাশিয়ার ক্ষেত্রে তা আরও ১২০ দিন বৃদ্ধি করতে হবে। দুই. যেসব রপ্তানি প্রমাণাদি ব্যাংক কর্তৃক ফরেন বিল পারসেস বা এফবিপি হয়েছে, তা আরও ১২০ দিনের জন্য ওভারডিউ-বহির্ভূত রাখতে হবে। তিন. এই আওতাবহির্ভূত সমস্যার কারণে বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবর্তনের সময়ের জন্য ব্যাংকগুলো যেন ওভারডিউ ইন্টারেস্ট চার্জ বা সুদ ফি আরোপ না করে সে অনুরোধ করেছে এফবিসিসিআই ও বিএফএফইএ।

এ প্রসঙ্গে বিএফএফইএর সিনিয়র সহসভাপতি এম খলিলউল্লাহ বলেন, রাশিয়ায় হিমায়িত চিংড়ি ও মাছ রপ্তানির বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা বা অর্থ বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন না। এ পরিস্থিতি ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ বাধার পর শুরু হয়েছে। রপ্তানির বিপরীতে প্রত্যাশিত অর্থ না পাওয়ায় ব্যাংকে জরিমানা গুনতে হচ্ছে। এ সংকটময় পরিস্থিতি উত্তরণে বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবর্তনের সময় বাড়ানো প্রয়োজন।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় রাশিয়ায় বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে ধস নেমেছে। মার্চে রাশিয়ায় মাত্র ২ কোটি ২৭ লাখ ১০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এ অঙ্ক গত বছরের একই মাসের চেয়ে ৬৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম। আর আগের মাস ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৬৮ দশমিক ২৫ শতাংশ কম।

এর আগে ২০২১ সালের মার্চে সম্ভাবনাময় বাজার রাশিয়ায় ৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিলেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীরা। যুদ্ধের কারণে মার্চে রাশিয়ার বাজারে রপ্তানি ৬৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ কমেছে। তবে অর্থবছরের নয় মাসের (জুলাই-মার্চ) হিসাবে এখনো ১৬ দশমিক ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আছে। এ নয় মাসে রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি থেকে ৫৫ কোটি ২৮ লাখ ২০ হাজার ডলার আয় হয়েছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো রাশিয়ান ব্যাংকের সঙ্গে সুইফট কোডের মাধ্যমে আর লেনদেন করছে না বলেই এ সংকট। রাশিয়ান ব্যাংকগুলো আগেই এ বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করেছিল। ইউক্রেনে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে রাশিয়ায় পোশাক রপ্তানি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে কেউ কেউ বলছেন বিকল্প পথে পেমেন্ট ও রপ্তানি অব্যাহত রাখা যাবে। জানা গেছে, যারা গত নভেম্বরের পর অর্ডার পেয়েছেন তাদের অর্ডার সরবরাহ পর্যায়ে রয়েছে। অনেকের চালান শিপমেন্ট পর্যায়ে আটকে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরেও কিছু কার্গো আটকে গেছে, যেগুলো রাশিয়ায় পাঠানোর কথা ছিল। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন সার্ভিসগুলোও রাশিয়ায় পণ্য পরিবহন করতে চাইছে না। পোশাক ব্যবসায়ীরা জানান, পাঠানোর চেয়ে বড় সমস্যা হলো পেমেন্টের। কোনোভাবে পাঠানো গেলেও পেমেন্ট এখন অনিশ্চিত।

জানা গেছে, যারা রপ্তানি করেছেন তাদের অনেকের পেমেন্টও আটকে গেছে। বিজিএমইএ থেকে তাদের সদস্য গার্মেন্টগুলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। রাশিয়ায় কমপক্ষে ১৫০টি পোশাক কারখানা তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। তারা দুই ধরনের সমস্যায় পড়েছেন। আগের পেমেন্ট আটকে যাওয়া এবং নতুন অর্ডার যারা সরবরাহ করার পথে ছিলেন, তারা সমস্যায় পড়েছেন। যদিও রাশিয়ায় তৈরি পোশাকের বাজার বড় হচ্ছিল। এখন সরাসরি শুধু রাশিয়ায় নয়, অন্য দেশ থেকেও বাংলাদেশি তৈরি পোশাক যা রাশিয়ায় যেত, তা-ও আটকে গেল।

সর্বশেষ খবর