নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষায় পুলিশ সদস্যদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলে পর্যবেক্ষণ এসেছে আপিল বিভাগের এক রায়ে। জনগণের করের টাকায় অতিরিক্ত সুবিধা-সুরক্ষা ভোগকারী এ বাহিনীর সদস্যদের নিজেদের পেশার মর্যাদা রক্ষায় আরও দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে ওই রায়ে। গত ৬ এপ্রিল এ রায় দেয় বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, বিচারপতি বোরহান উদ্দিন ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের আপিল বেঞ্চ। ৯ পৃষ্ঠার এ রায়টি লিখেছেন বিচারপতি বোরহান উদ্দিন। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে।
পুলিশের দায়দায়িত্ব মনে করিয়ে দিয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘পুলিশ সদস্যদের মনে রাখা উচিত, পুলিশ বাহিনীকে সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে এবং সরকারের রক্ষণাবেক্ষণে জনগণের করের টাকা থেকেই তারা অতিরিক্ত সুবিধা-সুরক্ষা ভোগ করছেন। যে কারণে পেশার মর্যাদা, নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষায় পুলিশ সদস্যদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত।’ নথি সূত্রে জানা গেছে, জনৈক ভারতীয় নাগরিক মো. আশফাক হোসেন ও তার ভাগ্নি মিনা মল্লিক বাংলাদেশে এক আত্মীয়ের বিয়েতে যোগ দিতে ১৯৯৪ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আশফাক হোসেন তার নিকটাত্মীয় গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাড়িতে ওঠেন। মিনা মল্লিক ওঠেন ওই আত্মীয়ের বাসায় (বিয়েবাড়িতে)। পরে ১৭ নভেম্বর মিনা মল্লিক তার মামা আশফাক হোসেনের সঙ্গে শহর দেখতে বেরিয়ে গ্রেফতার হন। এদিন দিবাগত রাত ১০টার দিকে ওই বাড়িতে (মিনা যে বাড়িতে ছিলেন) তল্লাশি চালায় পুলিশ। তখন তার আত্মীয়রা জানতে পারেন, আশফাক ও মিনাকে পুলিশ আটক করেছে। সেদিন ওই বাসায় তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ কিছু পায়নি। এরপর ১৮, ১৯ ও ২০ নভেম্বর মাঝরাতে বাসাটিতে টানা তল্লাশি চালায় পুলিশ। তল্লাশির সময় মিনার একটি ব্যাগ নিয়ে নেওয়া হয়। যদিও ব্যাগের তালা-চাবি রেখে যায় পুলিশ। পরোয়ানা কিংবা অনুমতি ছাড়াই টানা চার দিন ওই বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। তল্লাশি শেষে আশফাক ও মিনাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। যদিও পরে তারা জামিনে মুক্তি পান। নথি সূত্রে আরও জানা গেছে, তেজগাঁও পুলিশের এমন হয়রানির মুখে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মিনার আত্মীয় মোহাম্মদ আলী এবং আরও কয়েক স্বজন। হাই কোর্ট রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুল জারি করে। রুলের জবাবে পুলিশ জানায়, তারা ওই বাসায় তল্লাশি করেনি। এমনকি মিনার কোনো ব্যাগও জব্দ করা হয়নি। বরং তেজগাঁও থানায় মিনার করা সাধারণ ডায়েরির (জিডি) পরিপ্রেক্ষিতে ১৭, ১৮, ১৯ ও ২০ নভেম্বর ওই বাসা পরিদর্শনে যায় পুলিশ। রুলের জবাবে আরও বলা হয়, আশফাক ও মিনা ভারতীয় নাগরিক। তাঁরা অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। যে কারণে দ্য ফরেনার্স অ্যাক্ট, ১৯৪৬-এর ১৪ ধারায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। উভয় পক্ষের শুনানির পর ২০০১ সালের ২৫ জুন হাই কোর্ট রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেয়। রায়ে রিট আবেদনকারীকে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তেজগাঁও থানার ওসি ও এক পুলিশ সদস্যকে ৫ হাজার টাকা করে এ ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়। পরে ২০০২ সালে এ রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন বিবাদীরা। ২০০৪ সালের ২১ জুলাই আপিলের অনুমতি দিয়ে হাই কোর্টের রায় স্থগিত করে আপিল বিভাগ। এরপর গত ১, ৮ ও ১৫ মার্চ ওই আপিলের শুনানি হয়। আপিলকারী পক্ষ শুনানিতে অংশ নিলেও রিট আবেদনকারীপক্ষ শুনানিতে অংশ নেয়নি।
এর মধ্যে আপিলকারী দুজনই (তেজগাঁও থানার ওসি ও একজন পুলিশ সদস্য) ক্ষতিপূরণের টাকা মওকুফ চেয়ে আবেদন করেন। ওই আবেদনে তারা ওই ঘটনার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমাও চান।আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা এবং তাঁদের (দুই পুলিশের) গোটা চাকরি জীবনের কথা বিবেচনা করে ক্ষতিপূরণের টাকা মওকুফ করা হলো। আপিল নিষ্পত্তি করে এ রায় দেয় সর্বোচ্চ আদালত।