বৃহস্পতিবার, ১৯ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

সংকটে দিশাহারা ব্যবসায়ীরা

♦ ডলারের দাম আকাশচুম্বী যুদ্ধে আমদানিপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ♦ শিল্পে উৎপাদন খরচ বেড়েছে, বিনিয়োগ কমে যাওয়ার শঙ্কা ♦ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব সরকারের আত্মঘাতী পদক্ষেপ : এফবিসিসিআই

রুহুল আমিন রাসেল

বহুমুখী সংকটে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। মার্কিন ডলারের দাম এখন আকাশচুম্বী। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে বাণিজ্যে। আমদানিপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। প্রতিনিয়ত শিল্পের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ফলে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার শঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব সরকারের আত্মঘাতী পদক্ষেপ বলছে এফবিসিসিআই।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে এটা পরিষ্কার যে কোথাও কারসাজি হয়েছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকও সঠিকভাবে দেখভাল করেনি। মানি চেঞ্জারগুলোকে লাইসেন্স দেওয়া হলেও নেই কোনো মনিটরিং। এখানে শৃঙ্খলা আনতে কাজ করতে হবে।’

এই শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বিদ্যুতের ৫৮ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবতাবিবর্জিত। এ প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আবার গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বরং মূল্য না বাড়িয়ে সমস্যার সঠিক সমাধান করতে হবে। বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সরকারের একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। এসব বিষয়ে শনিবার সংবাদ সম্মেলন করবে এফবিসিসিআই। এদিকে বিদ্যুতের পাইকারি (বাল্ক) মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব সম্পর্কে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটর কমিশনের (বিইআরসি) কাছে মতামত দিয়েছে এফবিসিসিআই। সংগঠনটির দেওয়া মতামতে বলা হয়- বিদ্যুতের পাইকারি বা বাল্ক মূল্যহার বৃদ্ধির আবেদনে বার্ক আইন ২০০৩-২০০৫-এর ধারা ২২(ঘ) ও (চ), ধারা ৩১(২), ধারা ৩৪-এর ২(গ)(ঘ)(ঙ) এবং (চ)-এর উদ্দেশ্য ও শর্তাবলি যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়নি। মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের আবেদনকারী বিদ্যুতের দক্ষ ব্যবহার, সেবার মান, এনার্জি পরিচালনা, আন্তর্জাতিক মান ও কৌশল অনুসরণে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। আইনের ৩৪(২)(গ) ধারায় উল্লিখিত দক্ষতা, ন্যূনতম ব্যয়, ভোক্তার স্বার্থ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ এবং সরবরাহ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালনা করা হয়নি। ধারা ২২(চ)-তে উল্লিখিত এনার্জি সিস্টেম উন্নয়ন পরিকল্পনা যথাযথভাবে করা হয়নি। কেননা ৭০ শতাংশ ডিমান্ড চার্জসহ মূল্য পরিশোধিত অসম উৎপাদন কেন্দ্রগুলো জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে অব্যাহত রাখা হয়েছে। এফবিসিসিআই বলেছে, ক্যাপটিভ খাতে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখা হলেও বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত উৎপাদন কেন্দ্রগুলোয় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ বা সীমিত করা হয়েছে। ফার্নেস অয়েলের শুল্ক ৩৪ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। কয়লার ওপর ৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট, গ্যাসের ওপর ডিমান্ড চার্জসহ বিদ্যুৎ বিক্রির ওপর উৎসে কর আরোপ করা হয়েছে। জ্বালানির ওপর আরোপিত করভার ভোক্তাসহ দেশের উৎপাদনশীল কার্যক্রমের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা একটি বিধ্বংসী ও আত্মঘাতী পদক্ষেপ। আইন অনুযায়ী বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব কোনোভাবেই বিবেচনাযোগ্য নয়। এফবিসিসিআই মতামতে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে বলেছে, বৈশ্বিক মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ফলে বিশ্বব্যাপী আমদানি হওয়া পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও এর প্রভাবে শুল্ক বৃদ্ধি, শিপিং খরচ বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে উৎপাদন ব্যয় অত্যধিক বেড়ে গেছে, যার প্রভাব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি জনগণকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করছে। একইভাবে রপ্তানি শিল্পে উৎপাদন খরচ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টকর হচ্ছে। এতে রপ্তানি কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে, যার নেতিবাচক প্রভাব ব্যালান্স অব পেমেন্টে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এফবিসিসিআই আরও বলেছে, সঞ্চয় কমে যাওয়ার ফলে বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। এতে ব্যাংকিং খাতের অর্থপ্রবাহে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কাকে বিবেচনা করাও জরুরি হয়ে পড়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষি, শিল্প, সেবা ও উৎপাদন খাতে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মূল্যস্ফীতির প্রভাব জনজীবনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। অর্থনীতির উন্নয়নের চলমান ধারাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। এতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে এবং শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, যার প্রভাব জাতীয় অর্থনীতির ওপর পড়বে। এফবিসিসিআই বলেছে, কভিড পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ জ্বালানি তেল ও এলএনজির ওপর প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু জ্বালানি তেলের সাময়িক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা সমীচীন নয়। জ্বালানি তেল ও এলএনজির মূল্য আগের অবস্থায় ফিরে আসার পরই বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করা যেতে পারে। সরকার বিদ্যুৎ খাতের তহবিল থেকে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে। মতামতে আরও বলা হয়- সহস্র মেগাওয়াটসম্পন্ন গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ প্লান্ট অকার্যকর অবস্থায় পড়ে থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি তেল (এফও এবং ডিজেল) দ্বারা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। ভুল পরিকল্পনার জন্য এ ক্ষতি শিল্প খাত বহন করতে পারে না। কয়লাচালিত বিদ্যুৎ ও নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ প্লান্ট খুব তাড়াতাড়ি চালু হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য কভিড ও ইউক্রেন-রাশিয়া পরিস্থিতির মধ্যে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা কোনোভাবেই সঠিক হবে না। আমরা বুঝতে পারছি সরকার গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে, যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিদ্যুতের ট্যারিফ বৃদ্ধির আবেদনে প্রস্তাবিত ট্যারিফ বৃদ্ধির অর্থনৈতিক প্রভাব যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করা হয়নি।

সর্বশেষ খবর