শুক্রবার, ২০ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

তখনই চলে গেলেন যখন তাঁর প্রয়োজন সর্বাধিক

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর সর্বশেষ অভিভাবক, আমাদের সবার বিবেক, আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী চলে গেলেন এমন এক সময়ে যখন তাঁর প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম সাহেব বললেন যেহেতু আমার সঙ্গেই তাঁর শেষ সাক্ষাৎ ঘটেছিল, তাই আমি যেন কিছু লিখি। কিন্তু এই অসহনীয় শোকাবহ খবরের পর কলম চলছে না। সারা জীবন যে মহামানব সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সমস্ত ভয়ভীতি, রাঙা চক্ষু উপেক্ষা করে শক্তিশালী লেখনী দিয়ে বাঙালি জাতিকে সম্প্রীতির, অসাম্প্রদায়িকতার পথ দেখিয়ে প্রভাবিত করেছেন, আজ তাঁর বিদায়ের পর তাঁর স্থান পূরণের আর কেউ রইল না। মূল প্রশ্ন- কে তাঁর মতো সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এমন জোরালো ভাষায় লিখতে পারবে? এমন কেউ তো রইল না। একদিকে আমার সৌভাগ্য অন্তত শেষবারের মতো দেখার সুযোগ হয়েছিল এপ্রিল মাসের ২২ তারিখে হাসপাতালে এবং পরে ৩০ তারিখে যুক্তরাজ্যে আমাদের হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিমের বাসভবনে। যেদিন হাসপাতালে দেখা হলো তিনি ভালো করেই জানতেন তাঁর বিদায় সন্নিকটে, কেননা চিকিৎসক বলে দিয়েছেন তাঁর দুটি কিডনিই সম্পূর্ণ অকেজো হয়েছে বলে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের সুযোগ নেই। একটি ইনজেকশনের সাহায্যে তিনি কিছুদিন মাত্র বাঁচতে পারবেন। কথাগুলো চিকিৎসকরা গাফ্‌ফার ভাইকেই বলেছিলেন। ২২ এপ্রিল হাসপাতালে সাক্ষাতের শুরুর দিকে তিনি বললেন ‘এসে ভালোই করেছেন, আর দেখা নাও হতে পারে’। তবে  মৃত্যুর হাতছানি তাঁকে যতটা চিন্তিত করেছিল, তার চেয়ে তিনি অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন দেশে মৌলবাদের উত্থান নিয়ে, দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে। প্রায় দুই ঘণ্টা সাক্ষাৎকালে বারবারই এক প্রশ্ন তুলেছেন, এই ধর্মান্ধ, ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে কীভাবে নিশ্চিহ্ন করা যায়। তিনি বলেছেন, এদের শায়েস্তা করে দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জিইয়ে রাখার জন্য শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। তাঁকে আরও বহু বছর ক্ষমতায় থাকতে হবে। তাই প্রশ্ন করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ চেতনাবিরোধী কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে কি না? কদিন আগেই তাঁর তৃতীয় কন্যা বিনোতা চৌধুরীর অকাল মৃত্যুতে তিনি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলেন, এরপর আর তাঁর চোখের পানি বন্ধ হয়নি, মিনিটে মিনিটেই বিনোতার কথা টেনে এনে শিশুর মতোই কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। এই মহা শক্তিশালী পুরুষ, যার মন ছিল পাথরের মতোই কঠিন এবং নীতির প্রশ্নে আপসহীন, তাঁর মন অভাবনীয়ভাবে ভেঙে পড়েছিল কন্যার মৃত্যুর কারণে, কিন্তু তার পরও তিনি ত্যাজদীপ্ত ভাষায় ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পিছপা হননি। প্রশ্ন করেছিলেন তাঁর প্রস্থানের পর এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে লেখার জন্য কে থাকবে? তিনি আমার মেয়েদের খুবই স্নেহের চোখে দেখতেন, তাদের কথাও জিজ্ঞেস করতে ভুলেননি। আগামী নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কেউ যেন ক্ষমতায় না আসতে পারে সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন।

স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর লন্ডন থেকে তাঁর প্রকাশিত ‘বাংলার ডাক’ পত্রিকার প্রসঙ্গ টেনে বললেন- ‘জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল চাবিকাঠি নেড়েছিল বলে তিনি যা লিখেছিলেন, পরবর্তীতে সাক্ষী প্রমাণের ভিত্তিতে সেই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, আমি যে এক রায়ে জিয়াকে ঠাণ্ডা মাথার খুনি বলে উল্লেখ করেছিলাম, সেটি ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক একটি ভাষ্য। এখানে উল্লেখযোগ্য গাফ্‌ফার ভাইয়ের প্রকাশিত ‘বাংলার ডাক’ পত্রিকাই ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার ব্যাপারে সারা পৃথিবীতে প্রথম প্রতিবাদী পত্রিকা। মুক্তিযোদ্ধা গাফ্‌ফার ভাই মুক্তিযুদ্ধকালে  পশ্চিম বাংলা থেকে বিভিন্নভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বাংলার ডাক পত্রিকায় স্পষ্ট করে লিখেছিলেন ‘জিয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নয়, বরং পাকিস্তানি চর হিসেবেই পশ্চিম বাংলায় ছিল, যে কথা এক দিন প্রমাণিত হবে।’ ১৯৭৩ সালে তাঁর প্রয়াত স্ত্রীর মেরুদণ্ডে সংক্রমণের কারণে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়লে বঙ্গবন্ধুই তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, কিন্তু তিনি আর সুস্থ হতে পারেননি, বাকি জীবন হুইল চেয়ারেই কাটিয়েছেন, আর এই পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীকে গাফ্‌ফার ভাই-ই দেখাশোনা করেছেন ২০১৩ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। ৩০ এপ্রিল হাইকমিশনার সাঈদা মুনার বাসভবনে গাফ্‌ফার ভাইয়ের কন্যা বিনোতার স্মরণে যে সভা ডাকা হয়েছিল, সেখানে তাঁকে পৌঁছানোর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিশেষ ধরনের অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করায় গাফ্‌ফার ভাই যেতে পেরেছিলেন। হাইকমিশনারসহ বিভিন্ন বক্তা গাফ্‌ফার ভাই যে গোটা বাঙালি জাতির অভিভাবক সে কথাই বলেছেন। হাইকমিশনার বলেছিলেন- গাফ্‌ফার চৌধুরী সাহেব গোটা পৃথিবীর সব বাঙালির বাতিঘর। আমি এ কথা বলতে ভুলি নাই যে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত বাঙালির মনে গাফ্‌ফার ভাইয়ের বিচরণ থাকবে তাঁর অমর একুশে গানের জন্য। আমাদের ভাষণ শুনে গাফ্‌ফার ভাইয়ের চোখে পানি এসেছিল। সেখান থেকে বিদায়ের মুহূর্তেও বলেছিলেন, মানিক সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রুখতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত রাখতে হবে। তিনি আরও বলেছিলেন, মানিক তুমি যে মনোবল নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের অন্যতম বিচারক হিসেবে এদের বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ দিয়েছো, ঠিক একই শক্তি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার দায়িত্ব এখন তোমাদের ওপর, কেননা আমি তো আর বেশি দিন বেঁচে থাকব না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের এই অকৃত্রিম সৈনিক সেদিন বলেছিলেন দেশকে তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করা যাবে না। বিদায়ের পূর্বমুহূর্তে তিনি কবিগুরুর দুটি লাইন উচ্চারণ করেছিলেন যা ছিল ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই, যা দেখেছি, যা পেয়েছি, তুলনা তার নাই’। এই কবিতা পাঠ থেকে পরিষ্কার হয়ে গেল মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি তিনি শুনতে পাচ্ছেন। এরপর আমি এবং সুলতান শরিফসহ সেখানে উপস্থিত বাংলাভাষী কেউ কান্না থামাতে পারেননি। হাসপাতালে থাকাকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’ এর উল্লেখ করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর একুশে ফেব্রুয়ারি গানের স্বরলিপিও আগামী পৃথিবী কান পেতে শুনবে কি না। তাঁর সেই অমর গানের স্বরলিপি যে অনাদিকাল বাঙালি হৃদয়ে বেঁচে থাকবে, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু আজ প্রশ্ন তাঁর বিদায়ের শোক আমরা কী করে কাটাব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে এখন কে কলম ধরবে? তাঁর প্রয়াণে সে অধ্যায়টি আজ স্তব্ধ হয়ে গেল। তাই প্রশ্ন যে নীতি নিয়ে গাফ্‌ফার ভাইয়ের কলমযুদ্ধ চলছিল সেই নীতি চালিয়ে যেতে ভবিষ্যতে কে কলম ধরবে? কে আছে তাঁর মতো শক্তিশালী লেখক। তাঁর অভাব তো পূরণ হবার নয়। তিনি আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, সেটি আর হলো না।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর