অগ্নিদুর্ঘটনা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে অন্যতম ভরসা ফায়ার সার্ভিস। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সবার আগে পাশে দাঁড়ান এর কর্মীরা। হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে নিজেদের জীবন বাজি রাখতেও কার্পণ্য করেন না। কিন্তু দেশে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রত্যাশার জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি সংস্থাটি।
উল্টো জনবল সংকট, উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা ও আধুনিক সরঞ্জামের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই ফুটে ওঠে দুর্বলতা। বিশেষ করে সুউচ্চ ভবন, কলকারখানা কিংবা কেমিক্যাল গোডাউনের মতো জায়গায় বড় অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধসের মতো ঘটনায় দুর্বলতাগুলো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
গত ১০ বছরে সারা দেশে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশনের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে, কিন্তু আগুন নেভাতে বাড়েনি সক্ষমতা। এদিকে আগামী ১০ বছরে ফায়ার সার্ভিসকে ঢেলে আধুনিকীকরণ সংক্রান্ত নেওয়া একটি প্রকল্প দীর্ঘদিন ধরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঝুলে আছে বলে জানা গেছে।ফায়ার কর্মকর্তাদের দাবি, আধুনিক সরঞ্জামের সংকটের কারণে নয়, হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধির পেছনে মানুষের সচেনতার অভাবই দায়ী। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। অবশ্য ছোট অগ্নিকাণ্ডগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে সহজেই নিয়ন্ত্রণে আনতে দেখা গেছে সংস্থাটিকে।
তবে পুরান ঢাকার নিমতলী থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ঘটনায় কেমিক্যালের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের বড় দুর্বলতা দেখা গেছে। রাসায়নিকের আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষিত ১৫০ জন কর্মী রয়েছেন। তাদের কাজের জন্য রয়েছে বিশেষ সরঞ্জামাদি ও পোশাক। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে এমন প্রশিক্ষিত ১১ জন ফায়ারকর্মী থাকলেও শিল্প এলাকা সীতাকুন্ড ও পাশের কুমিরা ফায়ার স্টেশনে এ ধরনের প্রশিক্ষিত কেউ ছিলেন না। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, রাসায়নিকের আগুন নেভানোর জন্য বিদেশে প্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়ে ‘হ্যাজম্যাট’ নামের একটি ইউনিট রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের। এ ধরনের আগুনের ক্ষেত্রে ‘কেমিক্যাল প্রটেকশন স্যুট’ নামের বিশেষ পোশাক পরে কাজ করেন তারা। সদর দফতরসহ বিভাগীয় শহরে রাখা হয় এ দলের সদস্যদের। নিয়ম অনুযায়ী, প্রথমে ঘটনাস্থলে গিয়ে নিকটস্থ ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা সাধারণ আগুন হলে নিজে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করবেন। তবে আগুন যদি রাসায়নিক হয়, তাহলে অবশ্যই প্রশিক্ষিত হ্যাজম্যাট ইউনিটকে খবর দেবেন। ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতার বিষয়টি আপেক্ষিক। দেশ যখন উন্নতির দিকে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবে কেমিক্যলের ব্যবহারও বাড়ে। সে তুলনায় কি ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বেড়েছে? উন্নতি আর হ্যাজার্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতাও বাড়াতে হয়। এখন যদি বলি সক্ষমতা আছে তাহলে ভুল হবে। আবার যদি বলি সক্ষমতা নেই তাও ভুল হবে। কারণ ঝুঁকি নির্ণয়ের সঙ্গে সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। আগামী ১০ বছরে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত একটি প্রকল্প ইউএনডিপির সহায়তায় নেওয়া হয়েছে। ইউএনডিপি একটি প্রতিবেদন ১০ মাস আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। তা নিয়ে এখনো স্টাডি করছে মন্ত্রণালয়। ওই প্রতিবেদনে কেমিক্যাল হ্যাজার্ড এলাকায় কেমন ফায়ার সার্ভিস হবে, রূপপুর পারমাণমিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কেমন হবে, নদী এলাকায় কেমন হবে এবং শিল্প ও গার্মেন্টস এলাকায় কেমন হবে তার বিস্তারিত বলা আছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, সারা দেশে ল্যাডার (মই) রয়েছে ২১টি। ঢাকায় রয়েছে মাত্র ১১টি। এর মধ্যে সম্প্রতি সর্বোচ্চ ৬৪ মিটারের পাঁচটি ল্যাডার কেনা হয়েছে। এগুলো ২২ তলা পর্যন্ত আগুন নির্বাপণে সক্ষম। ৫৪ মিটার ও ২৭ মিটারের ল্যাডার রয়েছে। বিশেষায়িত গাড়িও বাড়ানো হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসে বিশেষায়িত গাড়ি এখন প্রায় ৬০০টি। ফায়ার কর্মীরা মনে করেন, ল্যাডারসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আরও প্রয়োজন। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংকট নিরসনে সম্প্রতি জাম্বু কুশন, লাইট ডিউটি রেসকিউ বোট, ডাইভিং অ্যাপারেটাস, এয়ার কমপ্রেসর মেশিন যুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া রাতে অভিযান পরিচালনার জন্য রিমোট কনট্রোল ফায়ার ফাইটিং ইউনিট, হেভি ডিউটি লাইট ইউনিট, কেমিক্যালে আগুন নির্বাপণে সক্ষম পাঁচটি অত্যাধুনিক গাড়ি, টোয়িং ভেহিক্যাল, পোর্টেবল পাম্প, বিদ্রিং অ্যাপারেটাস, ওয়াটার রেসকিউয়ের জন্য রাবার বোট, বহুতল ভবনে রেসকিউ করার জন্য ৩০ মিটার গভীরে কাজ করতে সক্ষম হ্যামার ও স্মোক ইজেক্টরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যুক্ত করা হয়েছে। অগ্নি নির্বাপণী ও উদ্ধার সরঞ্জাম ভেহিক্যালের মোট সংখ্যা ৪ হাজার ৩৯৪টি। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ১০ বছর আগে সারা দেশে ২০৪টি ফায়ার স্টেশন থাকলেও বর্তমানে ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা ৪৮৯টি। পাশাপাশি ঢাকা, গাজীপুর নারায়ণগঞ্জ ও রূপপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে ১১টি আধুনিক ফায়ার স্টেশন। ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়েনি জনবল ও আধুনিক সরঞ্জাম। বর্তমানে সংস্থাটির জনবল রয়েছে ১৩ হাজার ৪৭৩ জন। ফায়ার সার্ভিসের সংকট কাটাতে কমপক্ষে ৩০ হাজার জনবল দরকার বলে মনে করেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম শ্রেণির ফায়ার স্টেশনগুলোতে ৩৫ জন করে জনবল থাকার কথা। এর মধ্যে ফায়ারম্যান থাকার কথা ২২ জন। কিন্তু বাস্তবে ১৫-১৬ জনের বেশি ফায়ারম্যান নেই প্রথম শ্রেণির স্টেশনেও। একইভাবে দ্বিতীয় শ্রেণির ফায়ার স্টেশনগুলোতে মোট জনবল থাকার কথা ২৭ জন করে। এর মধ্যে ফায়ারম্যান থাকার কথা ১৬ জন। কিন্তু এসব স্টেশনে ৮-১০ জনের বেশি ফায়ারম্যান নেই। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রাথমিকভাবে আগুন নির্বাপণের সক্ষমতা রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের। আমরা পানি এবং কেমিক্যাল দিয়ে আগুন নিভিয়ে থাকি। অগ্নি নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসের প্রত্যেক কর্মী পারদর্শী ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এখন ফায়ার সার্ভিসের যেসব সরঞ্জাম রয়েছে, সেগুলো আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যথেষ্ট।