দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। উজানের ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে নতুন করে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। মুহুরী নদীর চার স্থানে নদী রক্ষা বাঁধ ভেঙে ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামের ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। রংপুরে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বগুড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, টাঙ্গাইল, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে নতুন নতুন এলাকায়। নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের খবর :
ফেনী : টানা বর্ষণ ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মুহুরী নদীর চার স্থানে নদী রক্ষা বাঁধ ভেঙে ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামের ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, মাছের ঘের ও গ্রামীণ সড়ক। গতকাল সকাল ৭টার দিকে ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের উত্তর দৌলতপুর ও ৯টায় দেড়পাড়ায় নদী রক্ষা বাঁধের দুটি স্থান ভেঙে যায়। পরে দরবারপুর ইউনিয়নের বরইয়া এলাকার বাঁধ ভেঙে যায়। দুপুর ২টার দিকে ভাঙে পরশুরাম উপজেলার অলকা গ্রামের একটি স্থান। সকালে বাঁধ ভেঙেই প্লাবিত হয় ফুলগাজী বাজার। তীব্র গতিতে পানি প্রবেশ করতে থাকে বিভিন্ন স্থানের লোকালয়ে। মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যায় শত শত মাছের ঘের।
তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপরে : তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার মানুষকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গঙ্গাচড়ায় মানুষকে সচেতন করতে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানরা মাইকিং করছেন। উজানের ঢলে গতকাল দুপুরে তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ পয়েন্টে বিপৎসীমা ৫২ দশকি ৬০ সেন্টিমিটার। তবে একই সময়ে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে।বগুড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি : বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। বিকালে যমুনার পানি বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। নতুন নতুন এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। সরকারি হিসেবে শুধু সারিয়াকান্দি উপজেলাতেই ৮৭টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর সঙ্গে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে জেলার সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার কিছু গ্রাম। কয়েকদিনে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৮৭টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। ২৩ হাজার ৯০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১ লাখ ১৭ হাজার ৩০০ মানুষ পানিবন্দি জীবনযাপন করছে। ৭ হাজার ৯০৫ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
টাঙ্গাইলে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত : টাঙ্গাইলে যমুনা, নিউ ধলেশ্বরী, পুংলী, ঝিনাই ও ধলেশ্বরী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা। পানিবন্দি হয়ে পড়ছে মানুষ। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি পোড়াবাড়ী পয়েন্টে ৩০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, পুংলী নদীর পানি জোকারচর পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ঝিনাই নদীর পানি ১৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বাঘাইছড়িতে প্লাবিত নিম্নাঞ্চল : একদিকে পাহাড় ধস। অন্যদিকে বন্যা। ভাঙছে পাহাড়ি সড়ক। সারা দেশের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হতে পারে রাঙামাটি। এমন শঙ্কায় দিন কাটছে পাহাড়ের মানুষের। টানা বৃষ্টিতে বেড়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও। গতকাল সকালে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি প্রধান সড়কসহ শহরের বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান।
লালমনিরহাটে পানি ও খাদ্য সংকট : পাহাড়ি ঢলে তিস্তা, ধরলা, রত্নাই, সানিয়াজান ও স্বর্ণামতি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে লালমনিরহাট জেলার পাঁচ উপজেলার অন্তত ৩০ হাজার পরিবার পাঁচ দিন থেকে পানিবন্দি। পানিবন্দি পরিবারগুলোর বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলায় বন্যার্তদের জন্য ১৫০ টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সিরাজগঞ্জে সংকট : যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ৩৪ সেন্টিমিটার এবং কাজিপুর পয়েন্টে ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার কারণে সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর ও চৌহালী উপজেলার প্রায় ২২টি ইউনিয়নসহ সিরাজগঞ্জ পৌরসভার কয়েকটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে।
নীলফামারীতে ২০ গ্রাম বন্যাকবলিত : তিস্তায় ফের পানিবৃদ্ধির ফলে জেলার ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ি, খগাখড়িবাড়ি, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছচাপানী, গয়াবাড়ি এবং জলঢাকা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি ও শৌলমারী ইউনিয়নের ২০ গ্রামের আট সহস্রাধিক পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
গাইবান্ধায় ৫৯ গ্রাম প্লাবিত : গাইবান্ধার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত বালাসীর তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ৪ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার ২০টি ইউনিয়নের ৫৯টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
কুড়িগ্রামে আরও অবনতি : কুড়িগ্রামের সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার ৯ উপজেলার ৫০টি ইউনিয়নের প্রায় ২৮৪টি গ্রামের দুই লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি।
পানি বাড়ছে হাওরে : নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি উপজেলা কলমাকন্দার ৩৪৫টি গ্রামের সবকটিতে পানিবন্দি সাধারণ মানুষ। মেঘালয়ের ঢলে সোমেশ্বরীর শাখা নদী উব্দাখালীর পানি বিপৎসীমার এখনো ৮৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নতুন করে বাড়ছে সদরসহ বারহাট্টার পানি। কংশ নদীর পানি গত দিনের চেয়ে ২০ সেন্টিমিটার কমলেও গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টিতে পানিবন্দি নেত্রকোনা সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের তাতিয়র নদীপারের কয়েক শতাধিক মানুষ।
হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি : হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল সারা রাত অঝোর ধারায় বৃষ্টির কারণে পানিবন্দি অন্তত আড়াই শ গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ। এখনো পানিবন্দি সব জায়গায় পৌঁছায়নি খাদ্য-সহায়তা। অনাহারে দিন কাটছে বানবাসীদের। গত চার দিনের বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাড়তে থাকে জেলার বিভিন্ন নদ-নদীর পানি। কালনি-কুশিয়ারা ও ভেড়ামোহনা নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করে। অধিকাংশ এলাকাতেই বন্যাদুর্গতরা এখনো বন্দি অবস্থায় রয়েছেন। তাদের কাছে পৌঁছায়নি খাদ্য-সহায়তা। অনাহারে দিন কাটছে বন্যাকবলিত মানুষের।
জামালপুরে আরও অবনতি : যমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ শাখা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গতকাল যমুনার পানি বেড়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বাড়ায় জেলার ছয় উপজেলায় অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। জামালপুরের ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ী ও বকশীগঞ্জ উপজেলার ৩০টি ইউনিয়নের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। তলিয়ে গেছে বসতভিটা, হাট-বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফসলি জমিসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়ক।
গোমতীর চরে ডুবে গেছে বাড়িঘর : টানা কয়েকদিনের বৃষ্টি আর উজানের ঢলে ডুবে গেছে কুমিল্লার গোমতী চরের বাড়িঘর। তলিয়ে গেছে কোটি কোটি টাকা মূল্যের সবজি। জেলার বুড়িচং উপজেলার ভান্তি এলাকায় প্রায় ডুবে যাওয়া সবজি খেতে মুলা তুলতে ব্যস্ত সফিকুল ইসলাম জানান, ৪০ শতক জমিতে মুলা চাষ করেছেন। তার ব্যয় হয়েছে ২০ হাজার টাকা। তার মতো ওই এলাকায় অন্তত ২০ জন কৃষক চরে মুলা, ঢেঁড়শ, পুঁইশাক, লাউ, চাল কুমড়ো, চিচিঙ্গা, বরবটি চাষ করেছেন। সবই এখন তলিয়ে যাচ্ছে।