সোমবার, ২৭ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

কাগজশিল্প ধ্বংসে মরিয়া আমদানিকারক চক্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

কাগজশিল্প ধ্বংসে মরিয়া আমদানিকারক চক্র

দেশীয় শিল্প। সেই শিল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিও করছে লাখো মানুষের। বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। অথচ ফিনিশড পণ্য অবাধ আমদানির কারণে এখন লোকসানি খাতে পরিণত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দেশের কাগজশিল্পের কথা। দেশের সম্ভাবনাময় এই শিল্প খাতটিকে ধ্বংস করার জন্য এখন মরিয়া আমদানিকারক চক্র।   

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মানসম্মত কাগজ উৎপাদন এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তা রপ্তানি হলেও নানা অজুহাতে বিদেশ থেকে কাগজ আমদানি বন্ধ নেই। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে দেশে অবাধে ঢুকছে আমদানিকৃত কাগজ। রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত আমদানি হওয়া কাগজ, বোর্ড, বস্ত্রসহ নানা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি হওয়ায় টিকতে পারছে না দেশি শিল্প। বিপুল অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পেরে লোকসান গুনছেন ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা কাগজশিল্প। ১০৬টি কাগজকলের মধ্যে টানা লোকসানের কারণে ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ৭৯টির বেশি। এ অবস্থায় বাজেটে কাগজশিল্পে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কাঁচামালের রাসায়নিকের আমদানি পর্যায়ে শুল্কহার হ্রাসের প্রস্তাব এবং আমদানিকৃত ফিনিশড পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপেরও দাবি করেছেন বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমএ)। এ ছাড়া পরিবেশ সহায়ক শিল্পকে উৎসাহ দিতে মাইক্রো ক্যাপসুলের আমদানি পর্যায়ে কাস্টম ডিউটি (সিডি) ২৫ শতাংশ সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় বিনা শুল্কে আনা নিম্নমানের কাগজ খোলাবাজারে দেদার বিক্রি হওয়ায় দেশীয় কাগজশিল্প মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। আমদানিকৃত কোটেড পেপার, গ্রাফিক পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট কার্ড, মিডিয়া পেপার, শেলফ অ্যাডহেসিভ পেপারে রাজধানীর বাজার সয়লাব। যাদের সহায়তায় এসব কাগজ বিক্রি হচ্ছে, তাদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে অব্যাহত রাখা হচ্ছে এ বাণিজ্য। কাগজ আমদানির বেশির ভাগ বন্ড আবার ভুয়া। অসাধু কর্মকর্তাদের ছত্রচ্ছায়ায় কাগজ আমদানিকারকরা এত শক্তিশালী যে, কয়েক দিন আগে পুরান ঢাকায় কাগজের মার্কেটে অভিযান চালাতে গেলে তাঁদের হাতে কাস্টমস কর্মকর্তাদের নাজেহাল হতে হয়। এমন প্রেক্ষাপটে কাগজ আমদানির ওপর শুল্ক বৃদ্ধির দাবি উঠেছে। বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে দেওয়া এক চিঠিতে আশঙ্কা করা হয়েছে, বন্ডের অপব্যবহার বন্ধ ও কাগজ আমদানিতে শুল্ক না বাড়ানো হলে দেশীয় কাগজশিল্প অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চেয়ারম্যানকে দেওয়া এক চিঠিতে বলা হয়েছে, কিছু ভুঁইফোঁড় ও স্বার্থান্বেষী আমদানিকারক এবং মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান দেশীয় মিল থেকে কাগজ সংগ্রহ না করে রেয়াতি শুল্কে কাগজ আমদানির পাঁয়তারা করছেন। এ অপতৎপরতার একমাত্র উদ্দেশ্য অমিত সম্ভাবনাময় দেশীয় কাগজশিল্প ধ্বংস করা। যেখানে দেশীয় কাগজকলকে উৎপাদিত কাগজ বাজারজাতকরণের জন্য ভ্যাট ও অগ্রিম আয়কর প্রদান করতে হয়, সেখানে রেয়াতি শুল্কে কাগজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হলে স্থানীয় ও আমদানিকৃত কাগজের মধ্যে তীব্র বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। তাই রেয়াতি শুল্কে কাগজ আমদানির প্রস্তাব বিবেচনা না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশন। বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) মহাসচিব ও মাগুরা পেপার মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল মহীউদ্দিন বলেন, ‘সব ধরনের কাগজ তৈরির সক্ষমতা আমাদের আছে। অতএব কোনো ধরনের কাগজ আমদানির প্রয়োজন নেই। বরং বাংলাদেশ থেকে ৪০টির বেশি দেশে কাগজ রপ্তানিও হচ্ছে। যেখানে রপ্তানি করার যোগ্যতা রাখে বাংলাদেশ, সেখানে আমদানি করা যথার্থ নয়। তাই দেশীয় শিল্পের বিকাশে আমদানি শুল্ক দু-তিন গুণ বাড়ানো উচিত।’ ভারতসহ বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে এই শিল্পোদ্যোক্তা বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশে আমদানিকৃত কাগজ থাকলেও খুব উচ্চ শুল্ক দিয়ে তা আমদানি করতে হয়। তাই আমাদের দেশেও একই নীতি গ্রহণ না করলে দেশীয় কাগজশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।’ দেশীয় কাগজশিল্পকে বাঁচাতে হলে আমদানিকৃত কাগজের ওপর শুল্ক বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিপিএমএর বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান মো. মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, রেয়াতি সুবিধায় কাগজ আমদানির সুযোগ দেওয়া হবে আত্মঘাতী। বরং ডলার সংকটের এই সময়ে যেখানে আমদানি নিরুৎসাহ করা হচ্ছে, সেখানে আমদানির ওপর আরও শুল্ক আরোপ করতে হবে এবং আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, ‘তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বিনা শুল্কে আমদানিকৃত কাগজজাতীয় পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করে এরই মধ্যে হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। এর সঙ্গে বিনা শুল্কে পাঠ্যপুস্তকের জন্য ব্যবহৃত কাগজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হলে আর্থিক ক্ষতি আরও বাড়বে। দেশের কাগজশিল্প লোকসানে শেষ হয়ে যাবে।’

 

সর্বশেষ খবর