সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

ভর্তুকিতে যত সর্বনাশ

অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে, বিদ্যুতে ২৮ হাজার কোটি ও এলএনজি আমদানিতে ২৫ হাজার কোটিসহ মোট ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, বছর শেষে বেড়ে দ্বিগুণ

জিন্নাতুন নূর

পায়রার পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারায় প্রতি মাসে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানিকে ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে। এই ১০০ কোটি টাকার মধ্যে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিবি) প্রতি মাসে ২০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। কারণ, তারা নির্ধারিত সময়ে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে পারেনি। বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভাড়া দেওয়ার ঘটনা শুধু এই একটাই নয়। কয়েক বছর ধরেই দেশে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। ফলে যেসব কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা কাজে লাগে না, সেগুলোকে ভর্তুকি দিতে হয়। এরমধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বসে বসে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচ্ছে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কোম্পানি। জ্বালানি  নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, অতি প্রয়োজনীয় কিছু ভর্তুকির পাশাপাাশি কিছু লোকসানি ভর্তুকি ভোগাচ্ছে দেশকে। পাশাপাশি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, ভর্তুকি না কমালে সরকার টাকা কোথা থেকে পাবে?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভর্তুকির পরিমাণ দেশের ইতিহাসের অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আগে প্রতিবছর ২-৩ হাজার কোটি টাকা করে বাড়লেও এবার বেড়েছে কয়েকগুণ। এবার রেকর্ড ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির সাপেক্ষে সংশোধিত বাজেটে এই ভর্তুকি আরও বাড়ার কথা বলা হয়েছে। সরকার যেসব খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কৃষি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। কৃষি খাতে ভর্তুকির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সার। বিদ্যুৎ, কৃষি উপকরণ, উন্নত মানের বীজ কেনায় কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়া হয়। বিদ্যুৎ খাতের মধ্যে বিদ্যুৎ অন্যতম আর জ্বালানি খাতের মধ্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) অন্যতম। প্রণোদনা দেওয়া হয় পাট ও পোশাক রপ্তানি খাত ও প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রেও। ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় নগদ ঋণ নামেও একটি অধ্যায় আছে। যাকে ভর্তুকিই বলা চলে। এ ঋণ দেওয়া হয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ইত্যাদি সংস্থাকে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ জুলাই চুয়েট ক্যাম্পাসে এক অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে সংযুক্ত হয়ে জানান, সরকার বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে মোট ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখার জন্য গ্যাসের চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানিতে আমাদের ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। বর্তমান বাজেটে ৮৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভর্তুকি না কমালে সরকার টাকা কোথা থেকে পাবে? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার ওপর আমেরিকা ও ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে এবং সরকারকে কী পরিমাণ ভর্তুকি বাড়াতে হয়েছে তারও একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যে ফার্নেস অয়েলের মূল্য ছিল মাত্র ৭০৮ টাকা, সেটা ইউক্রেন যুদ্ধের পর হয়ে গেছে ১ হাজার ৮০ টাকা। অর্থাৎ ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এলএনজি যেটা মাত্র ১০ মার্কিন ডলারে ক্রয় করা হতো, যুদ্ধের ফলে সেটা এখন ৩৮ মার্কিন ডলার, অর্থাৎ ২৮০ শতাংশ দাম বেড়ে গেছে। আমাদের কয়লাও ১৮৭ মার্কিন ডলার ছিল, এখন ২৭৮ মার্কিন ডলার। বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬১ শতাংশ। ডিজেল ছিল ৮০ মার্কিন ডলার, তা এখন ১৩০-এ চলে এসেছে। শোনা যাচ্ছে ৩০০ ডলার পর্যন্ত দাম বাড়তে পারে। ভোজ্য তেলেরও দাম বাড়ছে। প্রত্যেকটি জিনিস যেগুলো কিনে আনতে হয়, তার দাম অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতি কিউবিক মিটার এলএনজি ক্রয়ে সরকারের ব্যয় ৫৯ দশমিক ৬০ টাকা। কিন্তু আমরা সেটা গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছিলাম মাত্র ৯ দশমিক ৬৯ টাকায়। যেটা সম্প্রতি ১১ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। তারপরও বিশাল অংকের ভর্তুকি রয়ে গেছে সেখানে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতি ইউনিটে উৎপাদন ব্যয় ১২ দশমিক ৮৪ টাকা কিলোওয়াট ঘণ্টা, কিন্তু এককপ্রতি পাইকারি মূল্যে আমরা দিচ্ছি ৫ দশমিক ০৮ টাকায়। ফার্নেস ওয়েলের প্রতি একক ইউনিটের উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে ১৭ দশমিক ৪১ টাকা, সেটাও আমরা ৫ দশমিক ০৮ টাকায় দিচ্ছি। ডিজেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ৩৬ দশমিক ৮৫ টাকা, সেখানেও আমরা ৫ দশমিক ০৮ টাকা দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করছি। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ১২ দশমিক ৩৭ টাকা, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ৫ দশমিক ০৮ টাকায়। অর্থাৎ সারা বিশ্ব এখন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, গত অর্থবছর বিদ্যুৎ খাতে সরকার ভর্তুকি দেয় ৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। আর গত অর্থবছর (২০২১-২২) ডিসেম্বর পর্যন্তই ছয় মাসে ভর্তুকি দেওয়া হয় ১০ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। তবে ঘাটতি ক্রমেই বাড়তে থাকায় ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বাল্ক মূল্যহার প্রায় ৬৯ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করে পিডিবি। তবে কারিগরি কমিটি ৫৮ শতাংশ দাম বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। পিডিবি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে বলেছে, উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করায় গত অর্থবছরে (২০২০-২১) তাদের ১১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। উৎপাদন ব্যয়ের কমে বিদ্যুৎ বিক্রি করায় এ অর্থবছরে তাদের লোকসান হতে পারে ৪০ হাজার কোটি টাকা। তবে গত এপ্রিল পর্যন্ত পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি পেয়েছে ১০ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। বিইআরসির কারিগরি কমিটি যে ৫৮ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করেছে, যা ভর্তুকি ছাড়া।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে জ্বালানি তেল কিনে দেশে তা অপেক্ষাকৃত বেশি দামে বিক্রি করে গত সাত বছরে বিপিসি বেশ মুনাফা করেছে। এ সময়ে বিপিসিকে কোনো ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে গেছে। খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে সংস্থাটি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভর্তুকি যা বরাদ্দ থাকে তার থেকেও বেশি দিতে হয়। ২০২০ সালে এই বিদ্যুৎ-জ¦ালানি খাতে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। যখন বিদ্যুতের দাম নির্ধারিত হয়। সেই  ভর্তুকি ৯ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হয়েছে। এবার ভর্তুকি চাওয়া হয়েছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা। এবারের গণশুনানিতে জ্বালানির মূল্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির হিসাবে সেই ভর্তুকি দাঁড়াচ্ছে ৫৮%, প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। মার্চের পরে এই পরিমাণ আরও বেশি হয়ে গেছে। আমাদের হিসাবে তা ৪০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি। তেলের দাম আরও বাড়ছে। আবার ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে কিন্তু খরচ হয়নি। যেমন এলএনজি খাতে সাড়ে ১০ হাজারে কোটি টাকার ওপরে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল, সেই ভর্তুকি খরচ না হওয়ায় ২০১৯-২০, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি বেচে গেছে। এলএনজি আমদানি করার কথা ছিল ৮ হাজার ৮৫০ এমএফসিএফডি কিন্তু আমদানি হয়েছে ৫০০ এমএফসিএফডির মতো। এলএনজির জন্য ভর্তুকি খরচ হয়নি। ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য সহনীয় রাখার জন্য এই ভর্তুকি প্রদান করার কথা বলা হচ্ছে কিন্তু বিদ্যুৎ-জ্বালানি উৎপাদন হয়ে তা ভোক্তা পর্যায়ে আসতে নানা ভ্যালু এডেড কস্ট যুক্ত হয়। আর তাতে যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে যুক্ত করা হয়। এ জন্য এ খাতে কম টাকার কাজ বেশি টাকা ব্যয়ে করানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে এ খাতে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বেড়ে যায়। আর ভর্তুকি দিয়ে এই লুণ্ঠনমূলক ব্যয়কে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। মূলত সেবা খাতে ব্যয় বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে এই ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। 

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান (সচিব) এ বি এম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভর্তুকি সরকারের একটি পলিসির ব্যাপার। আমাদের আর্থিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে কমে আসছে এবং সেটা আর কতদিন যাবে তা নিখুঁতভাবে বলা না গেলেও এই আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হতে যাচ্ছে। এখনো আমরা সরকারের কাছে কোনো ভর্তুকির জন্য অর্থ চাইনি। তবে বিপিসির অর্থ মানেই সরকারের অর্থ। বিপিসি এরই মধ্যে ভর্তুকি দিয়ে ফেলেছে। গত পাঁচ মাসে আমাদের সব মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে জ্বালানি তেলের অতিরিক্ত উচ্চমূল্যের কারণে। সরকার সে অর্থ এরই মধ্যে ভর্তুকি দিচ্ছে। বিপিসির অর্থ মানে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের অর্থ। সরকারের কাছ থেকে এখনো না নিলেও বিপিসির এ পর্যন্ত যা সামর্থ্য ছিল তা দিয়ে সরকারের পক্ষে ভর্তুকি দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে নিজস্ব ব্যয় দিয়ে সামনে চলা কঠিন হয়ে যাবে। তখন সরকারের কাছে ভর্তুকি চাইতে হতে পারে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, খোলাবাজারে তেলের চাহিদা বেড়ে গেছে সারা বিশ্বে প্রচ-ভাবে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেল ও গ্যাসের দামে প্রচ-ভাবে ইফেক্ট পড়েছে। ইউরোপের অধিকাংশ দেশ রাশিয়া থেকে গ্যাস নেয়। সেখানে তারা বন্ধ করে দিচ্ছে বলেই এখন ইউরোপের সব দেশ এই গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যে কারণে খোলাবাজারে যে গ্যাস ছিল ৪ ডলার, তা হয়েছে ৩০ ডলার। তা কিনতে গিয়েই আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। অর্থ জোগান দিতে আমাদের প্রচ-ভাবে বেগ পেতে হচ্ছে। সরকারের ভর্তুকি দিয়েও এই পরিমাণ অর্থের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে না এবং আমরা যদি মূল্যবৃদ্ধিই করতে থাকি, তাহলে সাধারণ জনগণের ওপর প্রচ-ভাবে চাপ সৃষ্টি হবে। তাই সবকিছু ভেবেই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর