সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা
বিশেষজ্ঞ অভিমত

সঠিকভাবে পরিকল্পনা হলে কমানো যেত : ম. তামিম

নিজস্ব প্রতিবেদক

সঠিকভাবে পরিকল্পনা হলে কমানো যেত : ম. তামিম

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেছেন, যদি বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে পরিকল্পনা সঠিকভাবে হতো তারপরও হয়তো ভর্তুকি দিতে হতো। কিন্তু অবশ্যই তখন হয়তো ভর্তুকির পরিমাণ কমে আসত। যদিও জ্বালানি নিয়ে বর্তমান বিশ্বে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে তার সঙ্গে সাধারণ অবস্থা তুলনা করা কঠিন বলেও মনে করেন এ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।

অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরও বিদ্যুৎ দিতে না পারাটা সরকারের জন্য বড় ধরনের বিচ্যুতি। তবে রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে আমরা বসিয়ে বসিয়ে বিদ্যুৎ দিচ্ছি এ কথা ঠিক না। যে রেন্টালগুলো আমরা সারা বছর বসিয়ে রাখছি সেগুলোর মধ্যে দুর্নীতি আছে। অনেক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র গরমকালে পিক আওয়ারে ব্যবহৃত হচ্ছে, কিন্তু শীতকালে হয়তো বসে আছে। চাহিদা কম থাকার কারণে সে সময় অনেক রেন্টাল কেন্দ্র বসে থাকে। মূলত গরমকালেই এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বেশি ব্যবহৃত হয়। এখানে কমপক্ষে চার মাসের মতো সময় বসিয়ে রেখে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। দেখার বিষয় হচ্ছে, কোনো রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সারা বছর খুবই কম ব্যবহার করে বা একেবারে ব্যবহার না করে বসিয়ে রাখা হচ্ছে কি না। নিয়ম হচ্ছে একদিকে যেমন প্রয়োজন না থাকলে শীতে বসিয়ে রেখেও রেন্টালের চার্জ দিতে হবে, অন্যদিকে যখন প্রয়োজন হবে তখন চাওয়ামাত্র কেন্দ্রগুলো তার উৎপাদনের ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ দিতে বাধ্য। যদি তারা বিদ্যুৎ দিতে অক্ষম হয় তাহলে যতদিন বিদ্যুৎ দিতে পারবে না তার জন্য তাদের পেনাল্টি দিতে হবে। অনেক রেন্টালের চাহিদা থাকে না কিন্তু তারপরও সংশ্লিষ্টরা এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিচ্ছে। তবে আংশিক বসে থাকলেও অধিকাংশ রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রই কিন্তু বিদ্যুৎ দিচ্ছে। সব রেন্টাল কেন্দ্রও সারা বছর ব্যবহৃত হয় না। আমাদের সারা বছরের সর্বনিম্ন বিদ্যুতের যে চাহিদা তা শুধু গ্যাস দিয়ে পূরণ করা যাচ্ছে না। আবার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সারা বছর চালানোও যায় না। এদের মাঝে মাঝে বিরতি নিতে হয়। ঢালাওভাবে বলা যায় না রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে চার্জ দেওয়া হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে যে দুর্নীতি হচ্ছে না এমন নয়। সেখানে অনেক ধরনের শুভংকরের ফাঁকি আছে। আবার গ্যাসভিত্তিক রেন্টাল কেন্দ্রগুলোয় সরকার কিন্তু ভর্তুকি দিচ্ছে না। তাদের উৎপাদন খরচও অনেক কম। ড. ম. তামিম বলেন, তবে এ মুহূর্তে একটি ইউনিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যা আগে কখনো হয়নি। এখন যদি তেলের ব্যারেল ১০০ ডলার হয়ে থাকে, গ্যাসের সমপর্যায়ের ব্যারেলকে যদি তেলে কনভার্ট করতে হতো সেটা প্রায় ৩০০ ডলারের সমান হতো। অর্থাৎ আমদানিকৃত এলএনজি দিয়ে যদি এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় তাহলে তা ৩০০ ডলারের তেলের সমপর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে তেলের দাম গ্যাসের দামের চেয়ে কম। যা গ্যাসের তিনভাগের একভাগ। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে যে খরচ পড়বে তা আমদানিকৃত গ্যাস দিয়ে করতে গেলে তিন গুণ বেশি খরচ পড়বে। কিন্তু সাধারণত সেটা থাকে না। গ্যাসের দাম তেলের চেয়ে কম থাকে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম এত বেড়ে গেছে যে, তা তেলের দামকে ছাড়িয়ে অনেক উপরে চলে গেছে। আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো দেরিতে উৎপাদনে আসছে, এটা  নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রথম পর্যায়ে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সে সময় বড় ধরনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।

উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, পায়রায় ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রাখা হয়েছে। এই যে এর সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দেরি হলো, এটি কি কারও নজরে পড়েনি। পদ্মা কসিং যে ঠিকমতো হচ্ছে না এটা তো জানা ছিল। এখন তিন-চার মাসে দেখি কেন্দ্রটির টাওয়ারগুলো বানিয়ে ফেলেছে। এ জন্য প্রতি মাসে ১৩০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে যাচ্ছি। শুধু তাই না, কেন্দ্রের যে মেশিন তার ওয়ারেন্টি হয়তো আর দুই বছর আছে তা দেড়-দুই বছর চালানোই হলো না, এর মধ্যেই গ্যারান্টি চলে গেল। এটা অপারেশনাল দিক থেকে মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হলে তখন পুরো টাকা আমাদের দিতে হবে। আমরা বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি, তুলনামূলকভাবে কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক কম। পায়রায় বসিয়ে রাখা ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ পেলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা কমত। আমি মনে করি, এখানে মারাত্মক সমন্বয়ের অভাব। একটি প্রকল্পে তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত দেরি হতে পারে। কিন্তু দেড় বছরের ওপরে হয়ে গেছে, পায়রার একটি ইউনিট বসিয়ে রাখা ক্রিমিনাল অফেন্স। কেন এ দেরি হলো এ জন্য অবশ্যই তদন্ত করা উচিত। এ জন্য কে দায়ী হবে! কোনো বিদ্যুৎ না নিয়ে এই যে মাসে মাসে তাদের টাকা দেওয়া হচ্ছে এ জন্য কে দায়ী হবে।

তিনি বলেন, যদি বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে পরিকল্পনা সঠিকভাবে হতো তারপরও হয়তো ভর্তুকি দিতে হতো কিন্তু এর পরিমাণ হয়তো কমানো যেত। তবে এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে তার সঙ্গে সাধারণ অবস্থা তুলনা করা কঠিন। আমরা শুনে এসেছি যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আমাদের সার্বিক বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমে আসবে। কিন্তু ২০১০ সালে প্রথম রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র  নির্মাণের চিন্তাভাবনা আসে। কিন্তু এর মধ্যে ১২ বছর হয়ে গেলেও এখনো এটি উৎপাদনে আসেনি। যদিও এর নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বাধা আসে। অন্যদিকে পায়রা তিন-চার বছরের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। এখানে অভিজ্ঞতার অভাব আছে।

সর্বশেষ খবর