মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

লোকসানে কাবু রেল

লোকসান হচ্ছে কিন্তু সুফল পাচ্ছে জনগণ। অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা : রেল ডিজি

উবায়দুল্লাহ বাদল

লোকসানে কাবু রেল

৮ জুলাই, সকাল ৭টা। কমলাপুর রেলস্টেশন। দেওয়ানগঞ্জ বাজারগামী ইন্টারসিটি তিস্তা এক্সপ্রেস। রফিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম) বড় ব্যাগ নিয়ে উঠলেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ‘ছ’ বগিতে। যাবেন জামালপুর। বাড়ি শেরপুরের নকলায়। গাড়িতে উঠেই চেষ্টা করলেন বাঙ্কারে ব্যাগ রেখে কারও সঙ্গে সিট শেয়ার করতে। সিট নাই তাহলে প্রথম শ্রেণির এই বগিতে কেন? জানালেন, টিকিট পাননি কিন্তু গাড়ির অ্যাটেনডেন্সকে (স্টাফ) ১ হাজার টাকা দিয়ে উঠেছেন এই বগিতে। টিকিট চেকার এলে ম্যানেজ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন ওই স্টাফ। কিছুক্ষণের মধ্যে রফিকুলের মতো আরও ২০ থেকে ২৫ জন যাত্রী ওঠেন ওই বগিতে। তাদের প্রতিজনের কাছ থেকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। ময়মনসিংহ যাওয়া পর্যন্ত বগিতে বাড়তেই থাকে ভিড়। গাড়ি জামালপুর যাওয়ার পর ওই বগির অ্যাটেনডেন্স আসেন দুজনের কাছে বকেয়া টাকা নিতে। এভাবে কেন এসি বগিতে টাকা দিয়ে লোক তোলা হয়েছে- জানতে চাইলে ওই স্টাফ প্রথমে গরম হলেও পরক্ষণে নিচু গলায় বলেন, ‘স্যার, আমি এই বগির লোক নই। আমার বগি আরও পেছনে।’ অথচ ওই স্টাফকেই কমলাপুরে বগির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এভাবেই আসা-যাওয়া করা প্রতিটি ইন্টারসিটি ট্রেনে টাকার বিনিময়ে যাত্রী তুলছেন রেলের স্টাফ, রেলপুলিশের সদস্য ও ক্যাটারিং কোম্পানির কর্মীরা। বিশেষ করে খাবারের গাড়ির কর্মীদের বেতন অল্প হলেও এটাই তাদের মূল আয়ের উৎস বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

শুধু বিনা টিকিটের যাত্রীই নয়, রেলের টিকিট কালোবাজারিতেও কর্মচারীরা জড়িত থাকেন। কিছু দালাল রেল কর্মচারীদের সহযোগিতায় আন্তনগর ট্রেনের অধিকাংশ টিকিট কিনে নিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ফায়দা লোটেন। এ ছাড়া রেলের সম্পত্তি ইজারা ও হস্তান্তর, অবৈধ স্থাপনা তৈরি, কেনাকাটা, ভূমি অধিগ্রহণ, যন্ত্রাংশ নিলাম, টিকিট বিক্রি, ট্রেন ইজারা, ক্যাটারিং ইত্যাদির অনিয়ম তো আছেই। আর এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো কোনো রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। সম্প্রতি অনলাইন টিকিট জালিয়াতিতে রেলের সিস্টেম অ্যানালিস্টসহ একাধিক কর্মচারী জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া যাত্রীবাহী ট্রেন পরিচালনায় বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ছাড়াও বাংলাদেশ রেলওয়ের অন্য একাধিক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। খাতগুলো হলো সম্পত্তি ইজারা ও হস্তান্তর, অবৈধ স্থাপনা তৈরি, কেনাকাটা, ভূমি অধিগ্রহণ, যন্ত্রাংশ নিলাম, টিকিট বিক্রি, ট্রেন ইজারা, ক্যাটারিং ইত্যাদি। এসব কারণে বছরের পর বছর লোকসান গুনতে হচ্ছে রেলকে। ১৯৭২ সালে কোটি টাকা লোকসান দিয়ে শুরু হলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে সেই লোকসান এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। সূত্র জানিয়েছে, যাত্রী ও পণ্যবাহী মিলিয়ে রেলওয়ে প্রতিদিন ৩৯৪টি ট্রেন পরিচালনা করে। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করে যা আয় হয়, এর চেয়ে বেশি অর্থ ট্রেনগুলো পরিচালনায় ব্যয় হয়। শুধু গত পাঁচ বছরে লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে যাত্রী ও পণ্যবাহী ট্রেনগুলো পরিচালনা করতে ২ হাজার ৮১২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে রেলওয়ে। বিপরীতে যাত্রীবাহী ট্রেনের টিকিট বিক্রি ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে সংস্থাটি আয় করতে পেরেছে ১ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা। লোকসান ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা। করোনা মহামারির কারণে এ বছরের একটা বড় সময় দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। এ কারণে লোকসান তুলনামূলক কম হয়েছে। পাঁচ বছরের মধ্যে রেলওয়ে সবচেয়ে বেশি লোকসান করেছে ২০১৯-২০ অর্থবছর। লোকসানের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয় হয়েছে ১ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। লোকসান ১ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। একইভাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। লোকসান ১ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭৬ কোটি টাকা। লোকসান ১ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ধারাবাহিক এ লোকসানের জন্য রেলের অনিয়ম-দুর্নীতিকে দায়ী করেছে খোদ রেলপথ মন্ত্রণালয়। অনেক সময় অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে প্রমাণিত হলেও জড়িতের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, করোনার প্রথম বছর সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির জন্য পূর্বাঞ্চল রেলের ২১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে রেলওয়ের তদন্ত কমিটি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে গত বছর ৫ নভেম্বর রেল সচিবের কাছে কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি দরে কেনাকাটার প্রমাণ পেয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এপ্রিল-মেতে কেনাকাটায় ৭৭৫ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ টাকার থার্মোমিটার ১২ হাজার ৩০০ টাকা, আট টাকার গ্লাভস ৩২ টাকায়, ১০ টাকার মিনি সাবান ২৫ টাকায়, ১২০ টাকা কেজির ডিটারজেন্ট ১৮৮ টাকায়, ১২০ টাকা কেজির ব্লিচিং পাউডার ১৯৩ টাকায়, ১৩০ টাকার হেক্সিসল ৩৮৪ টাকায়, ১২০ টাকার প্লাস্টিক চশমা ৩৯৭ টাকায়, ১৫০ থেকে ৪০০ টাকার চীনের তৈরি কেএন-৯৫ মাস্ক ৭২৭ টাকায় এবং ট্রলি ও ফ্লুমিটারসহ প্রতিটি অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনা হয় ৪১ হাজার টাকায়। কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, ওটিএম পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হলে অবাধ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো এবং প্রতিযোগিতামূলক দর পাওয়া যেত। এ ক্ষেত্রে তা না করে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। সিসিএস দফতর ও সিওএস দফতরের ২৯ কর্মকর্তা ক্রয়কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ যেমন সত্য, উচ্চ মূল্যে কেনাকাটার বিষয়টিও প্রমাণিত। কমিটি ২৯ কর্মকর্তাকে দায়ী করে ভবিষ্যতে তাদের এ ধরনের কেনাকাটার কাজ না দেওয়ার সুপারিশ করেছে। কিন্তু অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়ইনি, বরং প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কিছুদিন পর তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক যুগ্ম-সচিব ফয়জুর রহমান ফারুকীকে বদলি করা হয়। এর আগে রেলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়ায় রেলের অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীরকে ওএসডি করা হয়েছিল। এসব অভিযোগের বিষয়ে রেলের মহাপরিচালক (ডিজি) প্রকৌশলী ধীরেন্দ্র নাথ (ডিএন) মজুমদার নিজ দফতরে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রেলের লোকসান হচ্ছে কিন্তু এর সুফল পাচ্ছে জনগণ। স্বল্প ভাড়ায় তারা রেল ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ প্রায়ই পাই। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলেও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। ব্যবস্থা নিলে লোকবলের অভাবে রেল বন্ধ রাখতে হবে। রেলওয়ের অনুমোদিত পদের অর্ধেকই শূন্য। এ মুহূর্তে ২২ হাজার ৭০৪টি পদ খালি। ইতোমধ্যে নতুন করে ৪৭ হাজার ৬৩৭ জনের জনবল কাঠামো অনুমোদন হয়েছে। লোকবল সংকট কাটাতে প্রথম দফায় শিগগিরই নিয়োগ দেওয়া হবে ২ হাজার ৮৯৪টি পদে। এ ছাড়া রেলকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের আদলে রেলকে গড়ে তোলা হবে।’

দেশে প্রথম রেলওয়ের সূচনা হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা-জগতি রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালের আগে অবিভক্ত ভারতবর্ষে রেলওয়ে বোর্ডের মাধ্যমে তৎকালীন রেলওয়ে পরিচালিত হতো। সংস্থাটিকে লাভজনক সেবা খাত হিসেবে তৈরি করতে সরকার ১৯৭৩ সালে বোর্ডের কার্যক্রম বিলুপ্ত করে একে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করে। পরে ১৯৮২ সালে রেলপথ বিভাগ গঠন করা হয়। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে অথরিটি (বিআরএ) গঠন করা হলেও এর কার্যক্রম পরে আর অব্যাহত থাকেনি। ১৯৯৬-২০০৩ সময়কালে এডিবির অর্থায়নে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সড়ক ও রেলপথ বিভাগ থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল সরকার যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আওতায় রেলপথ বিভাগ নামে নতুন বিভাগ সৃষ্টি করে। ওই বছর ৪ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর