চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় ট্রেনের ধাক্কায় পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের ১৫ আরোহীর মধ্যে ১১ জন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। অন্যদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ ঘটনায় বিভাগীয় তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, দুর্ঘটনাস্থলের এই গেটে প্রায় সময় গেটম্যানসহ দায়িত্বশীল কেউ থাকেন না। মাঝে মাঝে অন্য লোকের মাধ্যমেই গেট ওঠানামা করেন গেটম্যানরা। গতকাল এই দুর্ঘটনার সময়ও কোনো ধরনের সিগন্যাল ছিল না, ছিল না গেটম্যানও।
ট্রেনের এক যাত্রী জানান, মাইক্রোবাসটি মহাসড়কের দিকে চলে যাচ্ছিল। বৃষ্টিও পড়ছিল। সড়কের লেভেল ক্রসিংয়ে সিগন্যাল বা প্রতিবন্ধক ছিল না। গেটম্যানও ছিলেন না। ফলে কোনো বাধা ছাড়াই মাইক্রোবাসটি রেললাইনের ওপর উঠে যায়। তখন মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কা লাগে।
রেলওয়ে প্রশাসন বলছে, ট্রেন আসার কথা বলে গেটম্যান মাইক্রো চালককে বাধা দিলেও তিনি কথা শোনেননি। ফলে মাইক্রোবাসের ওপর ট্রেনের ধাক্কা লাগে। তারপরও যেহেতু বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করা হয়েছে, সেই রিপোর্টে গেটম্যান বা অন্য কেউ দোষী হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরেই পূর্বাঞ্চলে প্রায় ১ হাজার ৩০০ এর ওপরে বৈধ-অবৈধ রেলগেট রয়েছে। এই রেলগেটের জন্য দায়িত্বশীল গেটম্যান থাকলেও বিভিন্ন গেটে না থাকার কারণেই ছোট-বড় অনেক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রেলওয়ের কর্মকর্তা বলেন, রেল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা না থাকায় অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। মূলত কেউ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না। এতে লেভেল ক্রসিংগুলোয় দুর্ঘটনা বেড়েই চলছে। তবে এসব রোধ করা না গেলে দুর্ঘটনা আরও বেড়েই যাবে বলে জানান তিনি। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা (ডিটিও) মো. আনসার আলী বলেন, শুনেছি, ট্রেন আসতেছে জানিয়ে গেটম্যান মাইক্রো চালককে বাধা দিলেও তিনি কথা শোনেননি। ফলে মাইক্রোবাসের ওপর ট্রেনের ধাক্কা লাগে। এটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। তারপরও যেহেতু বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করা হয়েছে, সেই রিপোর্টে গেটম্যান বা অন্য কেউ দোষী হলে আইনগত সুপারিশ এবং ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রেলওয়েতে একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে এবং বাস্তবায়নও হচ্ছে। এসব উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে। কিন্তু বৈধ কিংবা অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর বিষয়ে রেল প্রশাসন কঠোর নজরদারিতে রেখেছে। এসব নিয়েও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কাজ করছেন। তিনি বলেন, অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ করাসহ ক্রসিং ঘিরে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এবং কঠোরভাবে এসব নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।রেলওয়ে, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম থেকে মিরসরাই উপজেলা এলাকার দুর্ঘটনাস্থলের দূরত্ব প্রায় ৫৪ কিলোমিটার। ঘটনাস্থলের আগেই রয়েছে বড়তাকিয়া রেলস্টেশন। এই স্টেশনের ১ কিলোমিটার দূরে উত্তরেই ঘটেছে ঘটনাটি। রেলওয়েতে গেটের দায়িত্বে থাকার মধ্যে বিভিন্ন বিভাগ পরিচালনা করে। এদের মধ্যে প্রকৌশল বিভাগ এবং পরিবহন বিভাগ দেখাশোনা করে গেটগুলো। এতে মিরসরাইয়ের দুর্ঘটনাস্থলের গেটটি দেখভাল করে প্রকৌশল বিভাগ। মিরসরাই খৈয়াছড়া ঝরনা পর্যটন কেন্দ্র থেকে ফেরার পথে মাইক্রোবাসটি ঢাকা থেকে আসা প্রভাতী ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ট্রেনটি ধাক্কা দেওয়ার পর মাইক্রোবাসটিকে প্রায় ১ কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায়।
অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং : রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে রয়েছে শত শত বৈধ-অবৈধ লেভেল ক্রসিং। এই লেভেল ক্রসিংয়ে হচ্ছে দুর্ঘটনা। বৈধ-অবৈধ মিলে প্রায় ৬০ শতাংশের ওপরে ক্রসিংই অরিক্ষত। পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে বৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে ৫১২টি। এর বাইরে প্রায় ৮০০-এর ওপরে ছোট-বড় অবৈধ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ঢাকা, লাকসাম, কুমিল্লা, মিরসরাই, সীতাকুণ্ডসহ চট্টগ্রাম নগরীর মধ্যে চট্টগ্রামের মেইন লাইনসহ শহর এলাকার মধ্যে চট্টগ্রাম-ভাটিয়ারী, চট্টগ্রাম-ফতেয়াবাদ জংশন পর্যন্ত প্রায় ৫৫টির বেশি গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এসব ক্রসিং দিয়েই প্রতিদিন সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চলাচল করছে যানবাহন। তবে রেলওয়ের নানাবিধ দিকনির্দেশনামূলক পরিকল্পনার অভাবে কোনো না কোনো সময় ঘটছে ট্রেন দুর্ঘটনা। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অবৈধ ক্রসিংয়ের বেশির ভাগই তৈরি হয়েছে এলজিইডি, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাস্তার কারণে।