বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

কারসাজির শেষ নেই ডলারে

আলী রিয়াজ

কারসাজির শেষ নেই ডলারে

ডলার নিয়ে কারসাজি এখনো শেষ হয়নি। নানা পদক্ষেপের পরও ডলার কারসাজি চক্র আরও সংঘবদ্ধভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। খোলাবাজারের কারসাজি চক্রের সঙ্গে যোগ হয়েছে বেশকিছু ব্যাংক। চরম অস্থির বাজারে ডলারের দর গতকাল রেকর্ড ১১৯ টাকায় পৌঁছেছে। কারসাজিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ছয় ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ব্যবস্থা নেওয়ার পর বিশেষ চক্র অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ফলে ফের হুন্ডি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে ডলার পাচারকারী চক্র তৎপর হয়ে উঠেছে। চক্রের কারসাজির কারণে ব্যাংকে চাহিদামতো ডলার না পেয়ে ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে গিয়ে পড়ছেন বিপাকে। বেশি দাম দিয়ে খোলাবাজার থেকে ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এ পরিস্থিতিতে কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, ডলার নিয়ে যে কারসাজিতে একটি গোষ্ঠী জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে বাজার স্থিতিশীল হবে না।

ডলার পরিস্থিতি খারাপ হওয়া শুরু হলে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়। এমনকি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এড়াতে ডলার কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করা হয় ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে। এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন উদ্বেগ জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। জসিম উদ্দিন বলেছেন, ডলার নিয়ে কারসাজি শুরু হয়েছে। অনেক শেয়ার ব্যবসায়ী ডলার ব্যবসায় জড়িত হয়েছেন। যারা এ কারসাজির সঙ্গে জড়িত তাদের শক্ত হাতে ধরতে হবে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সংকটে পড়বে। আমাদের ব্যাংকগুলোকে ব্যবসা করার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ১ ডলারের বিনিময়ে ১০-১৫ টাকা লাভ করার লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো যদি অনিয়ম করে তাদেরও ধরা উচিত। সরকারের উচিত এসব কারসাজি চক্রকে শক্ত হাতে দমন করা।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানিসহ খাদ্যপণ্যের দর বৃদ্ধির প্রভাবে দেশে ডলার সংকট শুরু হয়। এ সংকটের কারণে কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে ৮৬-৮৭ টাকার ডলার পৌঁছায় ৯৫-৯৬ টাকায়। এর পরই কয়েকটি ব্যাংকসহ খোলাবাজারে বেশকিছু এক্সচেঞ্জ হাউস কারসাজি শুরু করে লাখ লাখ ডলার কিনে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ডলারের দাম পৌঁছায় ১১২ টাকায়। এরপর এসব কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। রাজধানীর একাধিক এক্সচেঞ্জ হাউসে অভিযানে নানা অনিয়ম, কারসাজির প্রমাণ পাওয়া যায়। এতে সাত-আটটি এক্সচেঞ্জ হাউসের সনদ বাতিল করা হয় ও ৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে শোকজ নোটিস দেওয়া হয়। পরে ডলারের দর কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে ১০৯ টাকায় নেমে আসে। গত সপ্তাহের পুরোটা সময় ডলারের দর একই স্থানে থাকলেও চলতি সপ্তাহের শুরুতে সংকট যেন চরম আকার নেয়। খোলাবাজারে ডলারের দর আরও বেড়ে গতকাল ১১৯ টাকায় বিক্রি হয়। এ সংকটের কারণে এলসি খোলা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যাংকগুলোয় ডলারের ঘাটতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে কোনো কোনো ব্যাংক এলসি খোলা বন্ধ করার উপক্রম হয়েছে। কারসাজি রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব তফসিলি ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচার নথি তলব করে একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোয় অভিযান পরিচালনা করে। এতে ডলার কারসাজির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডসহ আরও পাঁচটি দেশি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব কর্মকর্তাকে অপসারণের নির্দেশ দেয়। তবু থামেনি কারসাজি।

চলতি সপ্তাহের এলসি তথ্যে দেখা গেছে, আগের সপ্তাহের চেয়ে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে। ব্যাংকগুলোয় ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে গেলে সরাসরি না করে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক লাক্সারি আইটেমের ক্ষেত্রে এলসি কড়াকড়ি করলেও মূলধনি যন্ত্রপাতি, কারখানার কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ দেয়নি। তবে ডলার সংকটের কারণ দেখিয়ে কোনো কোন ব্যাংক এলসি করা থেকে বিরত থাকছে। ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে দৌড়াতে হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রতিদিন ডলার সরবরাহ করা হয়। চাহিদার তুলনায় সেটা কম হলেও এলসি খুলতে গেলে ব্যাংকগুলো জানাচ্ছে কোনো ডলার নেই। ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে খোলাবাজার থেকে অতিরিক্ত দরে ডলার কিনে ব্যাংকে জমা দিয়ে এলসি খুলছেন। এতে ডলার অনেক বেশি দামে কেনা ছাড়াও আমদানি খরচ বাড়ছে ভয়াবহভাবে। যার প্রভাব পড়ছে দেশের পুরো অর্থনীতির ওপর।

ডলার সংকট কেন্দ্র করে হুন্ডি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠছে। তারা দেশের অর্থ পাচারের সুবর্ণ সময় হিসেবে নিয়েছে। একদিকে ব্যাংকে ডলার নেই, ব্যাংকগুলো ডলারের দর কম দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত দর হিসাব করলে বিদেশ থেকে ডলার এলে দর পাওয়া যাবে ১০০ টাকার কিছু বেশি। আর হুন্ডিতে পাঠালে দর পাওয়া যাবে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। অন্যদিকে ডলারের দর বাড়তে থাকায় মৌসুমি ডলার ব্যবসায়ীরা সক্রিয় হচ্ছেন। বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তা, এক্সচেঞ্জ হাউসের কর্মীরা ডলার কিনে নিজের সংগ্রহে নিচ্ছেন। লাখ লাখ ডলার দেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গতকালের ডলার বাজার ছিল সবচেয়ে বেশি অস্থির। সকালে শুরু হয় ১১৫ টাকা দিয়ে লেনদেন। তবে ঘণ্টার ব্যবধানেই ডলারের দর বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউসে ১১৯ টাকায় পৌঁছায়। এ দর বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হয়, ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের খোলাবাজারে পাঠানোর ফলে দাম বেড়ে গেছে। খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে ব্যাংকে জমা দিলেই কেবল এলসি খোলা যাচ্ছে। এতে বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা খোলাবাজারে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডলার নিয়ে এখন খুবই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। আমাদের ভিন্ন উৎস থেকে ডলার সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তাতে দাম যেমন বেশি দিতে হচ্ছে, আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যাচ্ছে। সংকট থেকে কীভাবে উত্তরণ করা যাবে সেটা অপেক্ষা ছাড়া বলা যাবে না।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর