রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারে প্লাস্টিক কারখানায় আবারও ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটল। প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় এ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে অন্তত ছয়টি পোড়া লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। গতকাল দুপুর ১২টায় চকবাজারের দেবীদাস ঘাটে এ ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যার হাউস পরিদর্শক আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আগুন নেভানোর পর তল্লাশি চালিয়ে আমরা ছয়টি লাশ পেয়েছি। নিহত ছয়জনের মধ্যে চারজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন- শরিফ (১৫), বিল্লাল (৩৩), স্বপন (২২) ও ওসমান (২৫)। লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের স্বজনরা শনাক্ত করতে না পারলে ডিএনএ টেস্ট করা হবে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা ফায়ার সার্ভিসের।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা সদর জোন-১ এর উপসহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ বলেন, ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের শরীর এমনভাবে পুড়ে গেছে যে তাদের চেহারা দেখে চেনার উপায় নেই। আগুনে পুড়ে ওই পাঁচ লাশের হাড় বেড়িয়ে গেছে। আরেকজনের চেহারা দেখলে কিছুটা বোঝা যায়। প্রাথমিকভাবে আমাদের ধারণা, তারা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। অগ্নিকান্ডের শুরুর দিকে হয়তো তারা মারা গেছেন।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, আগুনের সূত্রপাত যেখান থেকে হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেই বরিশাল হোটেলের পাঁচ কর্মী ভিতরে ছিলেন। তাদের মধ্যে থেকে কতজন বের হতে পেরেছেন তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ৬৯ জনের মৃত্যুর খবর রেকর্ড হয়। এদিকে আগুন লাগার শুরুতে ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট গেলেও পরে তাতে আরও দুটি ইউনিট যুক্ত হয়ে মোট ১০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। দুপুর ১২টায় লাগা আগুন বেলা ২টা ২০ মিনিটে নিয়ন্ত্রণে আসে। স্থানীয় ও উৎসুক জনতার কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। মাইকিং করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা বারবার বলতে থাকেন, ‘আপনারা প্লিজ সরে যান, দূরে যান। আমাদের আগুন নেভাতে দেন।’ এরপরও সেখানে মানুষের জটলা লেগেই থাকে। কেউ দাঁড়িয়ে আগুন দেখেন, কেউ ভিডিও করেন, কেউ আবার ফেসবুকে লাইভ করতে থাকেন।একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আনুমানিক ১২টার দিকে বিকট শব্দ শুনে বের হয়ে তিনি দেখেন, বরিশাল হোটেলে আগুন জ্বলছে। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আগুন শুরুতে বিদ্যুতের ট্রান্সফরমারে যায়। সেখানে আরেক দফা বিস্ফোরণের পর প্লাস্টিকের খেলনা তৈরির কারখানায় আগুন লাগে। এরপর সেখান থেকে আগুন আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে যেখানে আগুন লাগে সেটি চারতলা ভবন। ভবনটির নিচতলায় খাবারের হোটেল। তৃতীয় তলা পর্যন্ত পাকা, আর চতুর্থ তলায় টিনশেড ঘর নির্মাণ করা আছে। এ টিনশেড ঘরটি মূলত প্লাস্টিকের খেলনা উৎপাদন ও মজুতের গোডাউন। সকাল থেকে কারখানা বন্ধ ছিল। তাই অন্যদিনের তুলনায় কারখানায় শ্রমিকের উপস্থিতি কম ছিল। এ ভবনের আশপাশে আরও একাধিক পলিথিন কারখানা রয়েছে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, যে ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, সেখানে প্লাস্টিক, জুতা আর খেলনার কারখানা ছিল। ভবনের নিচতলায় ‘বরিশাল হোটেল’ নামে একটি হোটেল আছে। সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুন লেগেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস। বিস্তারিত তদন্তের পর আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। যে ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, সেটিসহ আশপাশের কোনো ভবন নির্মাণের নিয়মনীতি মানা হয়নি। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে এত দেরি হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন বলেন, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে এসব কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। চকবাজারের কয়েকজন জানান, সরকারি জমি লিজ নিয়ে এসব কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। যে হোটেল থেকে আগুন লেগেছে, সেখানে আগে গ্যাসের লাইন ছিল। বিল বকেয়া থাকায় হোটেলটির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। তখন থেকে তারা গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করছে।
নিহত ওসমানের (২৫) খালাতো ভাই রুবেল বলেন, যে ভবনে আগুন লেগেছে তার নিচতলায় বরিশাল হোটেলে কাজ করত ওসমান। রাতে কাজ করে ওই ভবনের দোতলায় ঘুমিয়ে ছিল। নিহত বিল্লালের (৩৩) আত্মীয় আবদুল্লাহ বলেন, তার দুলাভাই বিল্লালও বরিশাল হোটেলে কাজ করতেন। রবিবার রাতে নাইট ডিউটি শেষে ভবনের দ্বিতীয় তলায় ঘুমিয়েছিলেন তিনি। উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ৩ জুন রাসায়নিকের আগুনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল পুরান ঢাকার নিমতলী। আগুনের লেলিহান শিখা সেদিন কেড়ে নিয়েছিল শতাধিক প্রাণ। নিমতলী ট্র্যাজেডির তদন্ত প্রতিবেদনেও উঠে এসেছিল কেমিকেলের কারণেই আগুনের তীব্রতা বেড়েছিল। একই কারণ উঠে আসে চকবাজারের চুড়িহাট্টার ট্র্যাজেডির প্রাথমিক তদন্তেও। নিমতলীর ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তাকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। সেই টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর কেরানীগঞ্জে একটি রাসায়নিক শিল্প-কারখানা গঠনের জন্য একনেকে প্রকল্প গৃহীত হয়। এর মধ্যে পুরান ঢাকা থেকে বিপজ্জনক রাসায়নিকের গুদাম সরানোর জন্য কার্যত কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি।