বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ১৩ আসামি এখনো অধরা। ১৮ বছর ধরে এসব আসামির অবস্থানও শনাক্ত করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তাদের মধ্যে কেবল চারজনের নাম ঝুলছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড নোটিসের তালিকায়। বাকিদের নাম কেন তালিকায় দেওয়া হচ্ছে না এ বিষয়েও সদুত্তর নেই সংশ্লিষ্টদের। তবে রেড নোটিসের তালিকায় থাকা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে নিয়ে এখনো ধোঁয়াশায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। উঠছে নানা প্রশ্ন।
২০০৪ সালের সেই গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন। আহত হয়েছেন কয়েক শ। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেড় যুগ আগের সেই মর্মান্তিক ঘটনার বিচার নিম্ন আদালতে শেষ হলেও উচ্চ আদালতে মামলা এখনো বিচারাধীন। এ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ৫২ আসামির মধ্যে কারাগারে আটক আছেন ৩৩ জন। অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে তিন আসামির। করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বছর ১৫ আগস্ট মারা গেছেন কারাবন্দি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম। এ ছাড়া একই বছর ৪ নভেম্বর সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান মাওলানা আবদুস সালাম। জানা গেছে, একসময় ছয়জনের নাম ইন্টারপোলের রেড নোটিসে থাকলেও এখন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলটির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের নাম সরিয়ে ফেলা হয়েছে। রাতুল আহমেদ বাবুর নাম থাকলেও ছবি নেই। তবে হারিছ চৌধুরী বেশ কিছুদিন আগে ঢাকায় অসুস্থ হয়ে গেছেন এমন বিষয় একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও এর সত্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে- বিষয়টি উল্লেখ করে পুলিশ সদর দফতরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোতে (এনসিবি) দুই দফা চিঠি দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি)।
গতকাল এ বিষয়ে কথা হয় পুলিশ সদর দফতরের এনসিবির দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত ডিআইজি মহিউল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পলাতক থাকা ১৩ জনের মধ্যে আমাদের কাছে কেবল ছয়জনের নামসহ তাদের তথ্য পাঠানো হয়েছিল। ছয়জনের নাম রেড নোটিসে ঝোলানো হয়েছিল। পরে তারেক রহমান ও শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের নাম রেড নোটিস থেকে তুলে ফেলা হয়। তারা ইন্টারপোলকে বুঝিয়েছেন যে এটা রাজনৈতিক ঘটনা। তবে আমরা তাদের নাম পুনরায় ঝোলানোর চেষ্টা করছি।’অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওই ন্যক্কারজনক নৃশংস ঘটনার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল দুর্বৃত্তরা। আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে আমরা প্রত্যাশা করছি, পলাতক আসামিদের যে-কোনো মূল্যে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।’
জানা গেছে, তারেক রহমানের রেড নোটিস জারি হয় ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল আর কায়কোবাদের একই বছর ১২ নভেম্বর। তাজউদ্দীনের রেড নোটিস জারি হয় ২০০৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, হারিছ চৌধুরীর ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর এবং রাতুলের নোটিস জারি হয় ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। গতকাল এ মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ১৮ বছর ধরে পলাতক থাকা ১৩ জন হলেন- তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আহমদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ, জঙ্গিনেতা মাওলানা তাজউদ্দীন, মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মোরসালিন, মোহাম্মদ খলিল, মাওলানা লিটন ওরফে দেলোয়ার হোসেন ওরফে জোবায়ের, জাহাঙ্গির আলম বদর ও রাতুল আহমেদ বাবু। এর বাইরে পুলিশের সাবেক তিন আইজি খোদা বক্স, আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক এবং সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, সাবেক ডিসি ওবায়দুল হক খান ইতোমধ্যে সাজা খেটে বের হয়ে গেছেন।
পলাতকরা কে কোথায় : তারেক রহমান এক দশকের বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্যে রয়েছেন সপরিবার। ২১ আগস্ট ছাড়াও মুদ্রা পাচারের এক মামলায় সাত বছর এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজার রায় মাথায় নিয়ে তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে আছেন। পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছেন, পলাতকরা দেশের বাইরে রয়েছেন, এটা নিশ্চিত। কিন্তু কে কোথায় আছেন সে বিষয়ে কিছু ধারণা থাকলেও সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে একাধিক সূত্রের তথ্যানুযায়ী, তাজউদ্দীন দক্ষিণ আফ্রিকা বা পাকিস্তানে রয়েছেন। রাতুল রয়েছেন দক্ষিণ অফ্রিকায়। কায়কোবাদ মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে, হানিফ থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ায়, সাবেক সেনা কর্মকর্তা এ টি এম আমিন যুক্তরাষ্ট্র বা দুবাইয়ে, সাইফুল জোয়ার্দার কানাডায় রয়েছেন। আর জঙ্গি আনিসুল মোরসালিন ওরফে মুরসালিন ও মহিবুল মুত্তাকিন রয়েছেন ভারতের তিহার কারাগারে। চলতি বছর ১৪ এপ্রিল যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি মুফতি শফিকুর রহমানকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ ছাড়া ২২ মে মুফতি আবদুল হাইকে নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। ওই হামলায় ২৪ জন নিহত এবং কয়েক শ আহত হন। প্রাণে বেঁচে গেলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা) শেখ হাসিনার শ্রবণশক্তি। এ ঘটনার পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে জঙ্গিনেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করে মামলার অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এর দুই বছর পর ২০০৯ সালে মামলার অধিকতর তদন্তের আদেশ হলে আরও দুই বছর সময় নিয়ে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় সংস্থাটি। সিআইডির সাবেক অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক আবদুল কাহার আকন্দ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সম্পূরক অভিযোগপত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানসহ ৩০ জন আসামির তালিকায় যোগ হন। সব মিলিয়ে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২-তে। যেসব আসামি পলাতক এদের মধ্যে যারা বিদেশে রয়েছেন তাদের অবস্থান শনাক্ত করে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এটাই আমার প্রত্যাশা।’