শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

অভিযানেও থেমে নেই অপরাধীরা

চুরি ডাকাতি ছিনতাই বাড়ছেই উদ্বেগ পুলিশের

সাখাওয়াত কাওসার

অভিযানেও থেমে নেই অপরাধীরা

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রাজধানীসহ সারা দেশে চলছে র‌্যাব-পুলিশের অভিযান। প্রায় প্রতিদিনই গ্রেফতার হচ্ছে নানা অপরাধী। তবু থেমে নেই চুরি-ছিনতাইসহ ভয়ংকর অপরাধীরা। পুলিশের গত ছয় মাসের তদন্তে উঠে এসেছে, বর্তমানে সড়ক-মহাসড়ক এমনকি বাসাবাড়িতেও ডাকাতি আতঙ্ক বেড়েছে। মানুষকে জিম্মি করে অর্থ লুটে নেওয়া নতুন করে উদ্বেগে ফেলেছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশের প্রতিটি ইউনিটকে আরও সতর্ক থাকতে সম্প্রতি ১০ নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০ থানার ওসিকে বিশেষ বার্তা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। এলিট ফোর্স র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সম্প্রতি চুরি-ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বেড়েছে। তবে এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে র‌্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়নকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’ ডিএমপির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত চুরি ঘটেছে ১ হাজার ১৬৫টি। ডাকাতি ও ছিনতাই ৮৫টি। এসব নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৫ পুলিশ সদস্য। এ সময় অস্ত্র উদ্ধার মামলা হয়েছে ৪৫টি, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে ৪০টি। বৃহস্পতিবার কমলাপুর থেকে মিতুল রায় রণি নামে এক নারীর গলা থেকে সোনার চেন নিয়ে দৌড়ে পালানোর সময় ধাওয়া দিয়ে ছিনতাইকারী আরিফ হোসেনকে (২৯) আটক করে র‌্যাব-৩-এর একটি দল। তার কাছ থেকে অনেক ছিনতাইকারীর তথ্য পায় র‌্যাব। আরিফ নিজেই এর আগে দুবার গ্রেফতার হয়েছিলেন।

২৮ ছিনতাইকারী আটক  : রাতেই শাহজাহানপুর, মতিঝিল, মুগদা, পল্টন, হাতিরঝিল ও তেজগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে ছিনতাইকারী চক্রের ২৮ সসদস্যকে আটক করে র‌্যাব। তাদের থেকে ১৮টি মোবাইল ফোন, ৭টি সুইচ গিয়ার, ২টি অ্যান্টি কাটার, ৬টি ব্লেড, ১টি করে কাঁচি, ছুরি, ক্ষুর, বিষাক্ত মলমের কৌটা, সোনার চেন ও নগদ ৩২৪ টাকা জব্দ করা হয়। এদের অনেকেই এর আগে কয়েক দফা গ্রেফতার হয়েছিলেন। সিআইডিসূত্র বলছেন, বারবার অপরাধে জড়ানো ১০ হাজার অপরাধীর মধ্যে ৭০ শতাংশই ঢাকা মহানগরীর। বাকি ৩ হাজার সারা দেশের। গ্রেফতার হয়ে কিছুদিন জেল খাটেন তারা। জামিনে বেরিয়ে আবার অপরাধে জড়ান। প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার নতুন আসামির আঙুলের ছাপ জমা হচ্ছে সিআইডির তথ্যভাণ্ডারে। সাভারে ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন সজীব মিয়া। ২২ দিন কারাগারে থেকে জামিনে আসার তিন দিনের মাথায় ১৩ এপ্রিল ফের গ্রেফতার হন তিনি। গত বছর ৯ ডিসেম্বর রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় একটি বাসায় চুরির ঘটনায় গ্রেফতার হন ফরহাদ। ২০১৫ সালে গুলশানে চুরির পর ঘটনাস্থলের আলামতের ফরেনসিক ও বিভিন্ন কাপড় এবং জিনিসপত্রের ওপর থাকা আঙুলের ছাপ স্ক্যানিং ও কোডিং করে সিআইডি দেখতে পায় ফরহাদের আঙুলের ছাপের সঙ্গে মিলে গেছে। ২৮ আগস্ট রাজধানীর শ্যামলী লিঙ্ক রোড থেকে হাফিজুর রহমান ওরফে সকাল নামে এক জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই হাফিজ জানান, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের তালিকা করে তারা ডাকাতির পরিকল্পনা করেছেন। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘সঠিকভাবে তদন্ত না হলে অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না। যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে মামলার তদন্ত হলে এভাবে দ্রুততর সময়ের মধ্যে জামিনে বের হতো না। আবার বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেও একই ব্যক্তি একই অপরাধে জড়াচ্ছেন।’ ২২ আগস্ট রাতে রাজধানীর ইস্কাটনে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোজাম্মেল আহমেদের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের বাসার সাত তলায় গ্রিল কেটে চুরি করা হয় ৪০ লাখ ৬৫ হাজার টাকার ৪৫ ভরি সোনার গয়না। এ ঘটনায় তাঁর মেয়ে বাদী হয়ে রমনা থানায় মামলা করেন। গত রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। চলতি মাসেই রাজধানীর রূপনগরে ইস্টার্ন হাউজিং এলাকায় একজন কলেজ শিক্ষকের বাসায় দিনদুপুরে চুরি হয়। সকালে কলেজে যাওয়ার পর খালি বাসায় সকাল ৯টা থেকে ১২টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। বাসার তালা কেটে চোরেরা স্বর্ণালংকার ও ল্যাপটপ নিয়ে যায়। ওই শিক্ষক রূপনগর থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। মে-তে রাজধানীর হাতিরঝিলে একটি বাসার জানালার গ্রিল কেটে স্বর্ণালংকার, নগদসহ ১০ লাখ টাকার মালামাল চুরি হয়। হাতিরঝিল থানা পুলিশ জানায়, মহানগর প্রজেক্টের ডি ব্লকের ৩ নম্বর সড়কের ৬০ নম্বর বাড়িতে রাতে এ ঘটনা ঘটে। গৃহকর্তা আবরার হোসেন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ওই বাসায় ভাড়া থাকেন। তিনি সস্ত্রীক গ্রামের বাড়ি যাওয়ায় তাঁর বাবা বাসায় ছিলেন। রাতে গ্রিল কেটে ঘরে ঢুকে ৬ ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ ৪ লাখ টাকা, ২টি ক্যামেরা, ৪-৫টি হাতঘড়ি নিয়ে গেছে চোরেরা। ১৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরায় হাইওয়ে পুলিশের এসপি মোস্তাফিজুর রহমানের বাসায় চুরি হয়। এ ঘটনায় মামলা হলে উত্তরা পূর্ব থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে বাসার বাবুর্চি আজিজ শেখকে চুরি যাওয়া ৫ লাখ টাকাসহ ২৩ আগস্ট রাজশাহীর শাহ মখদুম থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। এর আগে ১৮ আগস্ট প্রগতি সরণির কুড়িল মিয়াবাড়ি এলাকায় ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইসহাক মিয়ার বাড়িতে দিনদুপুরে ঘটে চুরি। ভবনের নিচে ভাড়াটিয়ার ২টি মোটরসাইকেল নিয়ে পালিয়ে যায় দুই চোর। সিসি ক্যামেরায় চোরদের শনাক্ত করতে পারলেও এখন পর্যন্ত আটক করা যায়নি। সাম্প্রতিক ঘটা অপরাধের বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইদানীং বিভিন্ন ধরনের চুরির ঘটনা ঘটছে। এখন আমরা চুরির মামলাগুলোকেও মনিটরিং সেলে নিয়ে আসছি। বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোয়। এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সব ক্রাইম ডিভিশনকে।’

পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনা : পুলিশ সদর দফতর থেকে সারা দেশের সব ইউনিটকে দেওয়া নির্দেশনায় বলা হয়েছে : ডাকাতি ঘটলে এজাহারকারীর বক্তব্যের আলোকে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা করতে হবে। এজাহারকারীর তথ্যে অসামঞ্জস্য দেখা দিলে যাচাই-বাছাই করে দ্রুত বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। ডাকাতির মামলায় পুলিশ সুপার ও মেট্রো ডিসি মামলা তদারক করবেন। যে-কোনো এলাকায় ডাকাতি ঘটলে ও মামলা হলে পুলিশ সুপার নিজে অথবা ন্যূনতম একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তদারকি করবেন। সাজাভোগকারী ডাকাত ও জামিনপ্রাপ্ত আসামিদের প্রয়োজনীয় তথ্যসহ তালিকা তৈরি করে তাদের অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতে হবে। এ ছাড়া ডাকাতির ঘটনা উদ্ঘাটনে প্রয়োজন মনে করলে পাশের পুলিশ ইউনিটগুলোর সঙ্গে সমন্বয় বাড়াতে হবে। ঘটনার পরপরই সম্ভাব্য স্থানে আসামিকে গ্রেফতারে অভিযান চালিয়ে দ্রুত গ্রেফতার করতে হবে। ডাকাতি ও চুরির ঘটনায় বরখাস্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাবেক সদস্যদের তালিকা সংরক্ষণ করে তাদের অবস্থান ও গতিবিধির খোঁজখবর রাখতে হবে।

সর্বশেষ খবর