আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, হত্যা-ক্যু ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে বিএনপি অভ্যস্ত। নির্বাচন স্বচ্ছ হবে বলে বিএনপি শঙ্কিত।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে গতকাল স্থানীয় সময় সকালে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন এই যে যখন একটা স্বচ্ছ নির্বাচন হবে, এটা আসলেই আমার মনে হয় তারা শঙ্কিত। কারণ ভোট চুরি করে ক্ষমতায় যাওয়া আর ওই যে ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার লিস্টে রেখে ভোট করা- এই সুযোগ পাচ্ছে না বলেই বোধ হয় নির্বাচন নিয়ে তাদের এত শঙ্কা। নইলে শঙ্কা করার কিছু নেই।’ নির্বাচনে জিততে পারবে না বলেই বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে আসেনি মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০১৪ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি সেটা তো তার দলের সিদ্ধান্ত। তারা করে না এ জন্য, কারণ তারা জানে যে একটা সঠিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পরে তাদের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা থাকে না। কারণ তারা তো হত্যা-ক্যু ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে অভ্যস্ত; এটা হলো বাস্তব।’ আওয়ামী লীগই মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করেছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচন থেকে মানুষের ভোটের যে অধিকার সে অধিকারটা যেন নিশ্চিত হয় সে ব্যবস্থা আমরাই নিয়েছি।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ এ দেশে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে- মানুষের ভোটের অধিকার, মানুষের মৌলিক চাহিদার অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই আওয়ামী লীগ সারাজীবন সংগ্রাম করেছে।’ জনগণের ভোট চুরি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় কোনোদিনই আসেনি। আওয়ামী লীগ যতবারই ক্ষমতায় এসেছে জনগণের ভোটের মাধ্যমেই এসেছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যারা আজকে প্রশ্ন করে নির্বাচন নিয়ে, তাদের হলো অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীর দ্বারা সৃষ্ট দল; জনগণের ভোট নিয়ে কখনো ক্ষমতায় আসতে পারেনি। কাজেই তারা যদি প্রশ্ন করে সেই প্রশ্নটা এত গুরুত্ব দেওয়ার কী আছে আমি জানি না।’ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইভিএম একটা আধুনিক পদ্ধতি; পৃথিবীর বহু দেশে ব্যবহার হয়। আমরাও দেখেছি যেখানে যেখানে ব্যবহার হয়েছে সেখানে খুব রেজাল্ট পাওয়া গেছে এবং মানুষ তার ভোটটা স্বাধীনভাবে দিতে পেরেছে। তারপরও এর বিরুদ্ধে অনেকে আছে এটাও ঠিক; যাই হোক আমার কথা হচ্ছে আজকে নির্বাচন যতটুকু স্বচ্ছতা পেয়েছে এটা কিন্তু অতীতে ছিল না।’ নিউইয়র্ক সফর নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বন্ধুত্ব; বাংলাদেশের জন্য বন্ধুত্ব নিয়ে ফিরছি।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যে উন্নয়নের বিস্ময় এটাই সবাই বলতে চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমরা শান্তি চাই; যুদ্ধ চাই না, সংঘাত চাই না। এই বার্তাটা আমি সবার কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি সেটাই হচ্ছে আমার মনে হয় সবচেয়ে বড় কথা এবং সকলেই বাংলাদেশের প্রশংসা করেছে এবং আমাদের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা মহামারি ও বিশ্বে চলমান বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে খাদ্য ও জ্বালানি সংকট তৈরি হয়েছে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন দেশে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। নতুন এ সংকটের ফলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক পর্বে ভাষণ প্রদান করি। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে সৃষ্ট খাদ্য ও জ্বালানি সংকট এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির জন্য অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক পারস্পরিক সংহতি প্রদর্শন করা প্রয়োজন। এসব সংকটের কারণে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশসমূহ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সংকট ও বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই। সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করি। আমি বলেছি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত শান্তি ও উন্নয়ন ভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি বর্তমান সংকট নিরসনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের জন্য আমাদের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং সাফল্যের কথা তুলে ধরে অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু কার্যক্রমের প্রসারের জন্য আমি বিশ্বনেতাদেরকে আহ্বান জানাই। প্রযুক্তির ব্যবহারে সবার ন্যায্য ও সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত বিভাজন দূর করার ওপর গুরুত্বারোপ করি। শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বশান্তির লক্ষ্যে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ, সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা ও শান্তি বিনির্মাণ কার্যক্রমে আমাদের অঙ্গীকার এবং অংশগ্রহণের বিষয়টি তুলে ধরেছি। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আমাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছি। এ প্রেক্ষাপটে, এবারের সাধারণ অধিবেশনে করোনা মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা, বহুপাক্ষিকতাবাদ, বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা, বৈশ্বিক সংকটের মুখে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চ্যালেঞ্জ, সংকট মোকাবিলায় উপযুক্ত তথ্যপ্রযুক্তির অবকাঠামো গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনায় গুরুত্ব পায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে আমরা মিয়ানমার থেকে এক মিলিয়নের বেশি বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে আসছি। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে দ্বিপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উদ্যোগ কোনোটিই এখনো সফল হয়নি। মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও চলমান সংঘাত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে দুরূহ করে তুলেছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে জাতিসংঘকে কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য আহ্বান জানাই। প্রধানমন্ত্রী একই দিন রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ে বাংলাদেশ কর্তৃক আয়োজিত একটি উচ্চপর্যায়ের সাইড ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সৌদি আরব, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, গাম্বিয়া এবং বাংলাদেশ যৌথভাবে এই সভা আয়োজন করে। এ সভায় অন্যান্যদের মধ্যে সৌদি আরব, তুরস্ক, গাম্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এবং যুক্তরাজ্যের উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আমি ৫টি প্রস্তাব তুলে ধরি। প্রস্তাবসমূহ হলো- রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাজনৈতিক ও মানবিক সহায়তা প্রদান করা; আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও জাতীয় আদালতসহ আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) দায়ের করা মামলায় সমর্থন করা। জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অব্যাহত দমন-পীড়ন বন্ধে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা; আসিয়ানের পাঁচ দফা ঐকমত্যে মিয়ানমারের অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করা। মিয়ানমারে জাতিসংঘসহ মানবিক সহায়তাকারীদের নির্বিঘ্নে প্রবেশ নিশ্চিত করা। একই দিন আমি ইউএস-বাংলাদেশ বিজনেস কাউন্সিলের আয়োজনে একটি উচ্চপর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করি। এ বৈঠকে আমি তথ্যপ্রযুক্তি, নবায়নযোগ্য শক্তি, জাহাজ নির্মাণ, অটোমোবাইলস, ফার্মাসিউটিক্যালস, চিকিৎসা শিল্প, সামুদ্রিক শিল্প, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বেশ কয়েকটি হাই-টেক পার্কসহ বিদ্যমান অন্যান্য শিল্পে বিনিয়োগের জন্য মার্কিন ব্যবসায়ী নেতাদের আমন্ত্রণ জানাই।