মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা
দুই সেতু উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী

করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধে উন্নয়নের গতি শ্লথ

নিজস্ব প্রতিবেদক

করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধে উন্নয়নের গতি শ্লথ

নড়াইলে মধুমতী সেতু (ওপরে) ও শীতলক্ষ্যা নদীতে নাসিম ওসমান সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনা মহামারির ধাক্কা ও রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধ দেশের উন্নয়নের গতিকে অনেকটা শ্লথ করে দিয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের মানুষ এ কষ্ট ভোগ করছে।

গতকাল দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মধুমতী নদীর ওপর নির্মিত মধুমতী সেতু এবং শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর   নির্মিত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমান তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি এবং সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ঈসা ইউসেফ ঈসা আল দুহাইলান বক্তৃতা করেন। সেতুগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস ভিডিও কনফারেন্স সঞ্চালনা করেন। সেতু প্রকল্পের ওপর একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না। আমরা শান্তি চাই। মানুষের উন্নতি চাই। এই যুদ্ধ ও অস্ত্র বিক্রির প্রতিযোগিতায় যে অর্থ ব্যয় হয় তা সারা বিশ্বের শিশুদের জন্য ব্যয় করা হোক। তাদের চিকিৎসা, শিক্ষা ও ভালো জীবনের জন্য ব্যয় করা হোক। আজ বিশ্ববাসীর কাছে সেই আহ্বান জানাই। তিনি বলেন, আমি আজ সত্যিই খুব আনন্দিত যে, আমরা এ সেতু দুটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে পেরেছি। এ জন্য আমাদের দুই বন্ধুপ্রতিম দেশ সৌদি আরব ও জাপানের প্রতি আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। তাদের সহযোগিতায়ই আমরা বাংলাদেশের উন্নতি করতে পারছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতি মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় সরকার যোগাযোগ ব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। নতুন উদ্বোধন হওয়া সেতু দুটি বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতিকে ব্যাপকভাবে জোরদার করবে। তিনি বলেন, প্রথমবার সরকারে এসেই যমুনা সেতুর ওপর বহুমুখী সেতু নির্মাণ করে তাঁর সরকার। এ ছাড়া আরও অনেকগুলো সেতুর নির্মাণ সম্পন্ন করে। যার মধ্যে রয়েছে ধরলা সেতু, গাবখান সেতু, শিকারপুর ও দোয়ারিকা সেতু এবং ভৈরব নদের ওপরও সেতু নির্মাণ। সমগ্র বাংলাদেশকে একটি যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায় আনাই ছিল তাঁর সরকারের প্রচেষ্টা। তিনি বলেন, এখন আমরা দাবি করতে পারি দেশের সমগ্র এলাকার মাঝেই যেন যোগাযোগ স্থাপিত হয় সে কাজ আমরা করতে সক্ষম হয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের মধুমতী সেতু এবং নারায়ণগঞ্জে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু দুটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি জানান, প্রথমে কালনা সেতু হিসেবে বর্তমান মধুমতী সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও এটা যেহেতু মধুমতী নদীর ওপরে নির্মিত এবং মধুমতী নামটিও অনেক মিষ্টি তাই এর নাম মধুমতী সেতু রাখার সিদ্ধান্ত নেন। পাশাপাশি বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার প্রতিবাদকারী নাসিম ওসমানের নামে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর নামকরণ করেছেন। ইতিপূর্বে তাঁর সরকার নারায়ণগঞ্জবাসীর উন্নয়নে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর আরও দুটি সেতু এবং মুক্তারপুর সেতু নির্মাণ করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

শেখ হাসিনা তাঁর সরকারের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন, একের পর এক সেতু ও সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণের ফলে এখন মোংলা বন্দর আমাদের খুব কাছে এসে গেছে। সেই সঙ্গে আমাদের স্থলবন্দর বেনাপোল, ভোমরাসহ কুষ্টিয়া অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। এই যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে আমাদের ওইসব অবহেলিত অঞ্চলগুলো আরও উন্নত হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের পথ পরিক্রমায় তাঁর সরকারের প্রচেষ্টা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হলে আমাদের চট্টগ্রাম এবং মোংলা সমুদ্রবন্দর একটি আন্তর্জাতিক হাব হিসেবে গড়ে উঠবে। প্রধানমন্ত্রী এ সময় করোনাভাইরাস এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও নিষেধাঞ্জা এবং পাল্টা নিষেধাঞ্জার পরিপ্রেক্ষিতে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি সমগ্র দেশে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি ফেলে না রেখে সার্বিক উৎপাদন বাড়ানোর তাঁর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেন।

সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে আমরা সবাই মিলে নিরলস পরিশ্রম করে যাব, এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

নাসিম ওসমানের পরিবার সবসময় আওয়ামী লীগের জন্য অবদান রেখেছে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নারায়ণগঞ্জের নাসিম ওসমানের পরিবার সবসময় আওয়ামী লীগের জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে। এ ছাড়া নাসিম ওসমান বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকারী। সেই কারণে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত সেতুর নাম নাসিম ওসমানের নামে করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, শীতলক্ষ্যা সেতু নাসিম ওসমানের নামেই দিয়েছি, কারণ সে আমার ভাই কামালের বন্ধু ছিল এবং তার বাবা জোহা সাহেব আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। তার দাদা ওসমান সাহেব, বলতে গেলে আওয়ামী লীগের একটা ঘাঁটি ছিল তার বাড়ি। কাজেই তাদের পরিবারটা সবসময় অবদান রেখেছে আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধে। এমনকি নাসিম ওসমানের বাবা জোহা সাহেব ’৭১ সালে যখন আমার মা এবং আমরা সবাই ১৮ নম্বর রোড বর্তমানে ৯ নম্বর রোড ধানমন্ডি বাসায় বন্দি, ১৬ ডিসেম্বর যখন পাক হানাদার বাহিনী সারেন্ডার করে তখন কিন্তু আমরা মুক্তি পাইনি। সে সময় জোহা সাহেব ভেবেছিলেন আমরা বোধহয় মুক্তি পেয়েছি, তাই তিনি ওই রাস্তা দিয়েই আসেন। পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ওই বাসায় গুলি করলে তার গায়েও লাগে। কিন্তু তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। তাকে আমি স্মরণ করি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর যখন আমরা দিল্লিতে রিফিউজি, তখন তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন, বন্দি ছিলেন। মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন দিল্লিতে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৪ আগস্ট নাসিম ওসমানের বিয়ে হয়, বিয়েতে কামালও গিয়েছিল, কামাল ফিরে আসে। ১৫ আগস্টের পর নবপরিণীতা স্ত্রীকে রেখেই নাসিম সেই হত্যার প্রতিবাদ জানাতে চলে গিয়েছিল ভারতে এবং সেখানে সে এই হত্যার প্রতিবাদ করে। সেসব কথা সবসময় আমি স্মরণ করি। যদিও এক সময় সে আমাদের পার্টি করত না, অন্য পার্টিতে গিয়েছিল। কিন্তু আমার সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ ছিল এবং বড় বোন হিসেবে সবসময় আমাকে সম্মান করত। তার একটা আকাক্সক্ষা ছিল, এই সেতুটার জন্য বারবার আসত। যখন পার্লামেন্ট মেম্বার, তখনো বারবার আসত আমার কাছে, বলত আপা এই সেতুটা করে দেন। কিন্তু যখনই আমরা এই সেতুটা তৈরি করা শুরু করলাম, তখনই সে এই পৃথিবী থেকে চলে গেল। কাজেই তার নামে আমি এই সেতুটা উৎসর্গ করেছি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিম ওসমান সেতু উদ্বোধনের সময় উভয়প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম সেলিম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা, নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. মঞ্জুরুল হাফিজ, নবনির্বাচিত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বাবু চন্দন শীল, সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত, জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল, বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রশিদ প্রমুখ।  

নড়াইলে মধুমতি সেতু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক মুক্তি, নড়াইল-২ আসনের এমপি মাশরাফি বিন মর্তুজা, নড়াইলের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, পুলিশ সুপার সাদিরা খাতুন, নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস, সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন খান নিলু, মধুমতী সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুজ্জামান, নড়াইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মো. হাসানুজ্জামান প্রমুখ।

মধুমতি সেতুর গোপালগঞ্জ অংশে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে যুক্ত ছিলেন সংরক্ষিত ২৫ আসনের সংসদ সদস্য নার্গিস রহমান, জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা, পুলিশ সুপার আয়েশা সিদ্দিকী, গোপালগঞ্জ সড়ক জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সুরুজ মিয়া, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৗশলী তাপসী দাশ, ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (বাংলাদেশ)-এর অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী এমদাদুল হক, সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব আলী খান, টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবুল বশার খায়ের, কাশিয়ানী উপজেলা চেয়ারম্যান সুব্রত ঠাকুর, টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার মেয়র শেখ তোজাম্মেল হক টুটুলসহ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও স্থানীয়  আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

অন্যদিকে, মধুমতি সেতু উদ্বোধনের আনন্দ জনগনের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান মধুমতি সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া গোলচত্বরে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে সমাবেশ করেছেন। সমাবেশে কাশিয়ানী উপজেলা আওয়ামী সভাপতি মোক্তার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, মুকসুদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রবিউল আলম শিকদার, সাধারণ সম্পাদক সাইদুর ইসলাম টুটুল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

সর্বশেষ খবর