মঙ্গলবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বে জাপা

প্রেসিডিয়াম এমপিসহ নেতা-কর্মীরা জি এম কাদেরের পক্ষে, বহিষ্কৃতরা রওশনমুখী

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

দেবর-ভাবির দ্বন্দ্বে জাপা

আগামী ২৬ নভেম্বর জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের ডাকা    কাউন্সিল ঘিরে পার্টির চেয়ারম্যান ও দেবর জি এম কাদের ও ভাবি রওশন এরশাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে। এই ইস্যুতে পার্টির ৩৮ প্রেসিডিয়াম সদস্য, প্রেসিডিয়ামের বাইরে থাকা নয়জনসহ মোট ২৬ এমপি এবং সারা দেশের নেতা-কর্র্মীরা জি এম কাদেরের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অপরদিকে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর কাউন্সিলের মাধ্যমে জি এম কাদের চেয়ারম্যান হওয়ার সময় যাদের প্রেসিডিয়ামসহ কেন্দ্রীয়  পদে রাখেননি, বিভিন্ন সময়ে দল থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন- এমন পদবঞ্চিতরা রয়েছেন রওশন এরশাদের পক্ষে। প্রায় এক বছর ধরে ব্যাংককে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদকে সামনে রেখে দল থেকে বহিষ্কৃত ও বঞ্চিতরা জড়ো হয়ে বিদ্রোহী গ্রুপ গড়ে তুলেছেন রওশনের নামেই। জি এম কাদেরপন্থিরা বলছেন, রওশন এরশাদের কাউন্সিল ডাকার এখতিয়ার নেই। তার সঙ্গে দলের কেউ নেই। রওশনপন্থিরা বলছেন, রওশন এরশাদের কাউন্সিল ডাকার এখতিয়ার রয়েছে। জি এম কাদেরের পাশে থাকা প্রেসিডিয়ামসহ অধিকাংশ এমপি রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেই চলছেন। জানা গেছে, পার্টিতে জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে কাউন্সিল ডেকেছেন রওশন এরশাদ। উভয় বলয়ের অনুসারীরা মুখে জাপাকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালানোর কথা বললেও তাদের দৃশ্যমান কর্মকাণ্ডে দলটি ভাঙনের দিকেই যাচ্ছে। কেউ কেউ আড়াল থেকেই মদদ দিচ্ছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত ফের খণ্ড হতে পারে জাপা, এমন আভাসই দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। জি এম কাদের বলছেন, চিকিৎসার নামে ব্যাংককে রওশনকে জিম্মি করে রেখেছে একটি চক্র। তারা রওশনকে দিয়ে বিভিন্ন বিবৃতি ও চিঠিতে স্বাক্ষর করিয়ে তা গণমাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। তার দাবি, রওশন অসুস্থ। দলের রাজনৈতিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো মানসিক বা শারীরিক অবস্থায় তিনি নেই। রওশনপন্থিদের অন্যতম নেতা এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও জাপার সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী মামুনুর রশীদ দাবি করেন, পার্টির নেতা-কর্মী সবাই বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে রয়েছেন। তিনি বলেন, কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যবসায়ী ছাড়া জি এম কাদেরের সঙ্গে কেউ নেই।

জানা গেছে, ২৬ নভেম্বর কাউন্সিল ডাকার কারণে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে রওশন এরশাদকে সরিয়ে জি এম কাদেরকে বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছে জাপার একাংশ। এই ইস্যুতে রওশনপন্থিরা দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। এর পর সংকট আরও বেড়ে যায়। এ বিষয়ে জাপার এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, কাউন্সিল থেকে সরে না আসলে রওশন এরশাদ ও তার ছেলে সংসদ সদস্য সাদ এরশাদকে বহিষ্কার করা হবে। রওশনপন্থিরা বলছেন, দলে নানান অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আদর্শের অনুসারীদের একের পর এক বহিষ্কার করা হচ্ছে। এতে দলের তৃণমূল থেকে শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। যা দলের সাংগঠনিক শক্তিকে আরও দুর্বল করে দিয়েছে। এসব বিষয় দৃষ্টিতে আসার পরই রওশন এরশাদ জাপাকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে আগামী ২৬ নভেম্বর জাতীয় সম্মেলন (কাউন্সিল) আহ্বান করেছেন রওশন এরশাদ। অন্যদিকে জি এম কাদেরপন্থিদের ভাষ্য, সরকারের লেজুড়বৃত্তি থেকে বেরিয়ে এসে জাপা প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে জনগণের সামনে আসার যে যাত্রা শুরু করেছে, তা তারা বাধাগ্রস্ত করে বিশৃঙ্খলা চালাচ্ছে। তারা সরকারের মদদপুষ্ট বিশেষ কোনো গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করছে বলেও সন্দেহ তাদের। রওশনপন্থিদের বক্তব্য, জি এম কাদের বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। আগামী কাউন্সিলকে সামনে রেখে রওশনপন্থিরা নোয়াখালী, সিলেট বিভাগ, মৌলভীবাজার, খুলনা জেলা ও মহানগর, নড়াইল, যশোর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ জেলা ও মহানগর, নাটোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ জেলা সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি চূড়ান্ত করেছে। এ ছাড়া আরও ৩৫ জেলায় কমিটি গঠনের কাজ চলছে। তারা এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করছে। তবুও তাকে বিভক্তি বলে মানতে নারাজ পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি এসব কর্মকাণ্ডকে বিশৃঙ্খলা বলে মনে করছেন। তবে রওশনপন্থি হিসেবে তৎপরতায় প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে গোলাম মসীহ্, কাজী মামুনুর রশীদ, সাবেক এমপি জাফর ইকবাল সিদ্দিকী, সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, এসএমএম আলম, সাবেক এমপি এমএ গোফরান, সাবেক এমপি ও ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা, অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু, সাবেক এমপি ও ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মিলন, সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল হক নুরু, শ্রমিক নেতা শাহ আলম তালুকদার, মুক্তার উদ্দিন মাসুম, খন্দকার নুরুল আনোয়ার বেলাল, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মুস্তাকুর রহমান মুস্তাক, মিজানুর রহমান দুলাল, সাইফুল ইসলাম পিটু, মো. নজরুল ইসলাম, জহির উদ্দিন জহির, হাসনা হেনা, মনোয়ারা তাহের মানু ও শেখ রুনা, খন্দকার নুরুল আনোয়ার বেলালকে। এ ছাড়াও সদ্য অব্যাহতি পাওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি আবদুল গাফফার বিশ্বাস, বরিশাল মহানগর জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক মহসিন উল ইসলাম ওরফে হাবুল, রংপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এ কে এম আবদুর রউফ মানিক, ময়মনসিংহ জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. কে আর ইসলাম, এম এ সাত্তার, ফখরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, ইকবাল হোসেন, সাবেক উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম, ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ও নুরুল ইসলাম নুরুর নামও রওশনপন্থিদের সম্মেলন তালিকায় রয়েছে। সর্বশেষ রওশনপন্থিদের সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন জাতীয় পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য এক সময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সোহেল রানা।

সর্বশেষ খবর