মঙ্গলবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা
শেখ রাসেলের জন্মদিন আজ

বসন্তের বাতাসে শেখ রাসেল

ফরিদুর রেজা সাগর

বসন্তের বাতাসে শেখ রাসেল

আশির দশকের শেষ দিকের এক বিকাল।

গুলশানের চৌরাস্তায় তখন হু হু করে বাতাস বইছে। বসন্তকাল। এখনো শীত পুরোটা শেষ হয়নি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা রিকশায় চড়ে সেই রাস্তা দিয়ে গুলশান সিটি করপোরেশনের দোকানে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে বিকালে রিকশায় চড়তে তার খুব ভালো লাগে। রিকশায় চড়লে তার মনটাও ফুরফুরে হয়ে ওঠে। তিনি মন খুলে আকাশ দেখেন। নীল নীল মেঘ। সাদা সাদা মেঘ। দেখতে ভালো লাগে।

রিকশা রাস্তার দুই পাশের লেকের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলছে।

ঝিরিঝিরি বাতাসে মনটা কেমন জানি হয়ে গেল। মনের ভিতরে তার গভীর দুঃখ। ’৭৫-এ পিতা-মাতাকে হারিয়েছেন। কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রে ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে প্রাণ দিয়েছে তিন ভাই। কামাল, জামাল, রাসেল। সেই তীব্র শোক বহন করে তার জীবন বহমান।

শেখ রেহানার পাশে বসা আছে ববি। তার শিশুপুত্র। দুজন মিলে কখনো কখনো এমনভাবে বের হন। শেখ রেহানা হালকা চাদর মুড়ি দিয়ে আছেন। বোঝার উপায় নেই তিনি কে। এমনিতেই শেখ রেহানা নিরিবিলি, পর্দার আড়ালেই থাকতে পছন্দ করেন। তিনি জনসমাগমে আসতে চান না। পেছনে থেকেই তিনি সব কাজ করে থাকেন। দেশকে তীব্রভাবে ভালোবাসেন।

শেখ রেহানা ববির সঙ্গে গল্প করছেন।

ববি বলো তো এখন কোন ঋতু?

ববি চুপ করে মায়ের দিকে গভীর ভালোবাসায় তাকিয়ে আছে। মা বলে চলেছেন, বাবা এখন বসন্তকাল। শীত চলে গিয়ে বসন্তের শুরু। বসন্ত আমার খুব প্রিয় ঋতু। এই ঋতুতে ফুল ফোটে। রঙিন হয়ে যায় বাংলাদেশ। তুমি বাংলাদেশকে কেমন ভালোবাস?

ববি দুই হাত তুলে বলল,

অনেক ভালোবাসি। খালা বলেছেন, দেশ হচ্ছে মা, মায়ের চেয়ে কাউকে আমরা বেশি ভালোবাসি না। তোমার মতোই প্রিয় আমার দেশ।

এই বলে ববি মায়ের কাঁধে মাথা রাখল। অনেক কথা তখন মনে পড়ে শেখ রেহানার। ১৯৬৯-এর উত্তাল গণআন্দোলন। তখন শীত পড়েছে। এক বিকালে রিকশা নিয়ে দুই ভাইবোন ধানমন্ডির লেকের পাশে ঘুরতে বেরিয়েছে। শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধুর পুত্র-কন্যা। মনে পড়ে, ঘুরতে বেরিয়ে রাসেল হাজারটা প্রশ্ন করত। রাসেল বলেছিল, ছাদের কবুতরগুলো সে একদিন উড়িয়ে দেবে। পুরো আকাশ জুড়ে কবুতররা ডানা মেলে উড়বে। শেখ রাসেল ছিল দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার নয়নমণি। আদরের ছোটভাই। সারাক্ষণ হইচই করে বেড়াত বুবু বলে। ববিকে জড়িয়ে ধরে আবেগতাড়িত হয়ে গেলেন শেখ রেহানা। একটা গাড়ি তখন হঠাৎ করে পেছন থেকে জোরে হর্ন দিল। চমকে ওঠেন শেখ রেহানা। রিকশা তখন গুলশানের বড় রাস্তা ছেড়ে ছোট একটা নিরিবিলি গলিতে প্রবেশ করেছে মার্কেটের পেছন দিকে। জোরে জোরে হর্ন বাজতে লাগল। ববি আরও আঁকড়ে ধরল মাকে। বাইরে শীতল বাতাস বইছে। বসন্তের বাতাস।

২. ববি তখন ওর ছোট্ট স্কুলব্যাগ থেকে একটা খেলনা পিস্তল বের করে মায়ের হাতে দিল।

পিস্তল কেন বাবা?

ববি বলল,

মা তোমাকে সাবধান থাকতে হবে। অনেক সাবধান।

কেন বলো তো?

তুমি তো জানো আমার নানা-নানি, মামা কেউ নেই। মা তুমি আমাকে যেভাবে সাবধানে রাখ তোমাকেও তো সেভাবে সাবধানে থাকতে হবে।

কেন বলো তো?

শেখ রেহানার মনে পড়ে, সবাইকে কী নিষ্ঠুরভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। শেখ রাসেলের বয়সই বা কত ছিল? ববি হয়তো সেই সব কথাই শুনেছে। তার পরও শেখ রেহানা অবাক হয়ে ববির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ঝিরিঝিরি বাতাস বয়ে চলেছে। শেখ রেহানার ধানমন্ডির লেকের কথা মনে পড়ছে। তখন ধানমন্ডি এত ব্যস্ত এলাকা নয়। মেইন রাস্তায় দু-একটা গাড়ি চলে। রিকশা চলে অনবরত। ঢাকায় তখন রিকশাই প্রধান বাহন। রাসেলের একটা ছোট খেলনা সাইকেল ছিল। সেটা তার খুব প্রিয় ছিল। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিয়মিত আসতেন ৩২ নম্বরে। তাদের কেউ একজন রাসেলকে মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়ে ছবি তুলেছিলেন। কী সুন্দর সেই ছবিটা। রাইফেল হাতে রাসেল দাঁড়িয়ে আছে। এসব ভাবতে গিয়ে চোখ ভিজে আসে শেখ রেহানার। ববির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, বাবা তুমি কি ভয় পেয়েছ?

না মা। মা তখন গভীর আলিঙ্গনে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ববি, তোমাকে সারাজীবন অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বিপদে ভয় পেলে চলবে না। প্রতিবাদী হতে হবে। জীবন বড় সুন্দর। ববি মাকে জড়িয়ে ধরল। আবেগে সে থরথর করছে। মায়ের কথা সে মন দিয়ে শুনছে।

মায়ের দুই চোখে তখন হয়তো অশ্রু চিকচিক করছে। কিন্তু একই সঙ্গে মনে হচ্ছে ওই চোখে রয়েছে বিরাট আত্মবিশ্বাস। আর মানুষকে ভালোবাসার স্বপ্ন। রিকশা এগিয়ে চলেছে। বাইরে তখন হু হু করে বসন্তের বাতাস বয়ে চলেছে।

 

সর্বশেষ খবর