সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

৩০ মামলায় আসামি ১৫ হাজার

বিএনপির তিন বিভাগীয় গণসমাবেশ

শফিউল আলম দোলন ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

সারা দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা, মামলা ও গ্রেফতার অব্যাহত রয়েছে। বিএনপির তিনটি বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে দলের ১৫ সহস্রাধিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ৩০টিরও বেশি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় নামে ও বেনামে আসামি করা হয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি। পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের হামলায় আহত হয়েছেন ৫ হাজার নেতা-কর্মী। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে প্রায় ৩ হাজার নেতা-কর্মীকে। ৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম, ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহ ও সর্বশেষ ২২ অক্টোবর খুলনা বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে এসব হামলা-মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতরের ঘনিষ্ঠ সূত্রে গতকাল এসব তথ্য জানা গেছে।

এর আগে ২২ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৭২টি মামলা করা হয়। গতকাল পর্যন্ত দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে শতাধিক। নামে ও বেনামে আসামি করা হয়েছে দলটির ৩৮ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে। দলের কেন্দ্রীয় সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী তিনটি বিভাগীয় সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট মহানগর, জেলা ও থানা পর্যায়ে ৩০টিরও অধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, কিংবা তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যরা বাদী হয়েছেন। নামে-বেনামে গণহারে আসামি করা হয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীকে। হামলায় আহত হয়েছেন ৫ হাজারের অধিক নেতা-কর্মী। অনেকের অবস্থা গুরুতর। আর গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে প্রতিদিনই। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেফতার নেতা-কর্মীদের মধ্যে অধিকাংশকেই হয় গণসমাবেশে আসার পথে, কিংবা সমাবেশ শেষে যাওয়ার পথে, অথবা সমাবেশের আগের রাতে অভিযান/তল্লাশি চালিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে।

২২ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের গুলিতে এ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে যুবদল কর্মী শাওন, ভোলায় ছাত্রদল নেতা নূরে আলম ও আবদুর রহিম এবং যশোরে আবদুল আলীমসহ পাঁচজন কর্মী নিহত হয়েছেন। ঢাকা মহানগরীতেই গত দুই মাসে ২০টির বেশি মামলা করা হয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এতে নামে-বেনামে ৩ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের পক্ষ থেকে।

এসব বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান বলেন, ‘রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দমননীতি শুরু করেছে সরকার। মামলা-হামলাসহ জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে চাইছে ক্ষমতাসীনরা। তারা নিজেরাই হামলা ও টিয়ার শেল নিক্ষেপসহ আমাদের ওপর গুলি চালিয়ে তারাই আবার আমাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছে। কিন্তু এসব করে আর কোনো লাভ হবে না। কারণ গণআন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। ঢাকাসহ সারা দেশেই মানুষ মাঠে নামতে শুরু করেছে। আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন তিনটি বিভাগীয় গণসমাবেশে মানুষ কীভাবে অংশ নিয়েছে। কাজেই এই সরকারের পতন অনিবার্য। আর পতনের আগ পর্যন্ত আমরা মাঠ ছাড়ছি না।’

খুলনায় দুই মামলায় বিএনপির ৩৭০ নেতা-কর্মী আসামি : খুলনায় গত দুই দিনে রেলস্টেশন ও আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ভাঙচুরের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলায় ৩৭০ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভাগীয় গণসমাবেশের দিন ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ কার্যালয় ভাঙচুরের অভিযোগে গতকাল বিএনপির ২০০ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গতকাল বিকালে ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক কাজী মোবাশ্বের বাদী হয়ে এ মামলাটি করেন। মামলার এজাহারে দৌলতপুর থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল হক নান্নু, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মুর্শিদ কামাল, মহানগর যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি কাজী নেহিমুল ইসলাম, ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক ইমাম হোসেন, আড়ংঘাটা ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক মতলেবুর রহমান মিতুলসহ ৫৯ নেতা-কর্মী এবং অজ্ঞাত পরিচয় ১৫০ থেকে ২০০ জনকে আসামি করার কথা বলা হয়। দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল হোসেন বলেন, ‘বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি গ্রহণ করা হয়েছে। এখন তদন্ত করে আসামিদের গ্রেফতার করা হবে।’

এর আগে রেলস্টেশনে ভাঙচুরের অভিযোগে শনিবার রাতে খুলনার জিআরপি থানায় বিএনপির আরও ১৭০ নেতা-কর্মীর নামে মামলা করেন স্টেশন মাস্টার মানিক চন্দ্র সরকার। বিএনপি কর্মী ও পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় স্টেশনের দরজার গ্লাস ভেঙে যায়। এ অভিযোগে মামলাটি করেন স্টেশন মাস্টার।

টঙ্গীতে ২০০ নেতা-কর্মীর নামে মামলা : গাজীপুরের টঙ্গীতে বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের দুই শতাধিক নেতা-কর্মীর নামে মামলা করেছে পূর্ব থানা পুলিশ। বুধবার বিকালে পুলিশ বাদী হয়ে ৩৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ১০০-১৫০ জনকে আসামি করে এ মামলা করে। পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার বিকালে মহানগর আহ্বায়ক মো. সোহরাব উদ্দিনের মুক্তির দাবিতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল করে বিএনপি। এ সময় নেতা-কর্মীরা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করে। এ অভিযোগে পুলিশ মামলাটি দায়ের করে। পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আশরাফুল ইসলাম মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

আরও ৫৪ নেতা-কর্মীর নামে মামলা, বিদেশে থেকেও আসামি সোহরাব উদ্দিন : গাজীপুরে বিএনপির শোক র‌্যালি থেকে হামলার ঘটনায় মামলা করেছে পুলিশ। গত সপ্তাহে দায়ের করা এ মামলায় আসামি করা হয়েছে জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক মিলন, সাধারণ সম্পাদক শাহ রিয়াজুল হান্নান ও মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব শওকত হোসেন সরকারসহ ৫৪ জন সক্রিয় নেতা-কর্মীকে। এমনকি গাজীপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মো. সোহরাব উদ্দিন দেশের বাইরে অবস্থান করলেও এ মামলায় তাকেও আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় পুলিশ ১৩ জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে। নগরীর রাজবাড়ি রোডে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে থেকে র‌্যালিটি বের হয়ে কয়েক গজ যেতেই পুলিশ বাধা দেয় এবং ব্যানার ছিনিয়ে নেয়। বাধা উপেক্ষা করে বিএনপি নেতা-কর্মীরা সামনে এগোতে চাইলে পুলিশ এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ শুরু করে। এক পর্যায়ে পুলিশ টিয়ার শেল ও শটগানের গুলি ছোড়ে। এতে ছয়জন গুলিবিদ্ধসহ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন।

ময়মনসিংহে ৪০০ নেতা-কর্মীর নামে পুলিশের মামলা : ময়মনসিংহে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সংঘর্ষে পুলিশের তিন সদস্য আহত হওয়ার ঘটনায় বিএনপির ৪০০ নেতা-কর্মীর নামে মামলা করেছে পুলিশ। শনিবার রাতে কোতোয়ালি মডেল থানার উপ-পরিদর্শক জহিরুল ইসলাম বাদী হয়ে এ মামলা করেন। মামলায় ২৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৩৫০-৪০০ জনকে আসামি করা হয়।

ফরিদপুরে বিএনপির কয়েক শ জনের বিরুদ্ধে মামলা : ফরিদপুরে পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে করা মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাসহ জেলার কয়েক শ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়।

যশোরে ২০ নেতা-কর্মী কারাগারে : নাশকতার অভিযোগে করা মামলায় যশোর জেলা যুবদলের সভাপতি এম তমাল আহমেদসহ বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের ২০ নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। এর আগে গতকাল সকালে এসব নেতা-কর্মী যশোর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। বিচারক ইখতিয়ার উদ্দিন মোল্লা জামিন নামঞ্জুর করে ২০ নেতা-কর্মীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। যশোর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুরের একটি ঘটনায় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এ মামলায় নেতা-কর্মীরা হাই কোর্ট থেকে ছয় সপ্তাহের জামিন পেয়েছিলেন। এরপর গতকাল সকালে যশোর আদালতে হাজির হয়ে জামিন প্রার্থনা করলে আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

ফেনীতে ৩৬ নেতা-কর্মী কারাগারে : ফেনীর সোনাগাজী উপজেলা বিএনপির ৩৬ নেতা-কর্মীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে জেলা কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন ফেনী জেলা জজ আদালত। উচ্চ আদালত থেকে নেওয়া ছয় সপ্তাহের জামিন শেষে গতকাল তারা জেলা জজ ছালেহ মোহাম্মদ রুহুল ইমরানের আদালতে হাজির হলে তিনি জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। ফেনী জজ কোর্টের আইনজীবী মেজবাহউদ্দিন খান বলেন, ২৯ আগস্ট বিএনপির বিক্ষোভে পুলিশ ও বিএনপির কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০ আগস্ট বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুসহ ৪৭ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ১২০-১৩০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে পুলিশ বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা করে। এর আগে ১ সেপ্টেম্বর আবদুল আউয়াল মিন্টু হাই কোর্ট থেকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন পান। পরে তিনি ১০ অক্টোবর ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তার স্থায়ী জামিন মঞ্জুর করেন। মামলা দায়েরের পর পুলিশ এজাহারনামীয় মো. রিপন ও আলাউদ্দিনসহ ১৩ বিএনপি নেতা-কর্মীকে পৃথক অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। এ দুটি মামলায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের আগে গ্রেফতার হওয়া ১৩ নেতা-কর্মী এবং জামিন নামঞ্জুর হওয়া ৩৬ জনসহ মোট ৪৯ জন নেতা-কর্মী বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর