চিনির বাজারে অস্থিরতার পেছনে সাতটি কারণ খুঁজে পেয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সংস্থাটি চিনি পরিশোধনকারী মিলগুলোতে অভিযান চালিয়ে জানতে পেরেছে, পরিশোধনকারী মিল মালিকরা উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ায় বাজারে হঠাৎ চিনির সংকট দেখা দিয়েছে। অবশ্য উৎপাদন কমিয়ে দেওয়ার পেছনে গ্যাস সংকটকে দায়ী করেছেন মিল মালিকরা।
সূত্র জানায়, হঠাৎ বাজার থেকে প্যাকেট চিনি উধাও হয়ে যাওয়ার পর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের বেশ কয়েকটি টিম মাঠে নামে। তারা পরিশোধন মিলগুলোতে অভিযান চালিয়ে দেখতে পায় দেশের একটি বড় আকারের কারখানা চিনির উৎপাদন তাদের সক্ষমতার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ ৫০ ভাগ চিনি উৎপাদন কম হওয়ার পেছনে গ্যাস সংকটকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে। কোনো কোনো কারখানায় উৎপাদিত চিনির সাপ্লাই অর্ডারে কোনো মূল্য তালিকাও ছিল না। একটি কারখানা সরবরাহ আদেশ নেওয়ার পরও সময়মতো চিনি সরবরাহ করেনি। সে কারণেও বাজারে হঠাৎ চিনির সংকট দেখা দেয়। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের টিম মেঘনা সুপার রিফাইনারি, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ, আবুল মোনেম সুগার রিফাইনারি লি., দেশবন্ধু সুগার মিল এবং চট্টগ্রামের এস আলম সুগার রিফাইনারিতে অভিযান চালিয়ে এসব অনিয়ম দেখতে পায়।
অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য নিয়ে তারা দেখেছেন, দেশে চিনির কোনো ঘাটতি নেই। বর্তমানে অপরিশোধিত চিনির মজুদ ও পাইপলাইনে মোট ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৫ মেট্রিক টন চিনি মজুদ আছে। তারপরও বাজারে হঠাৎ চিনির সরবরাহ কমে যাওয়ার পেছনে তারা চিনি পরিশোধনকারী মিল মালিকদের কিছুটা দায় দেখছেন। সফিকুজ্জামান বলেন, চিনির বাজারে হঠাৎ সংকটের পেছনে কিছু মিল মালিকের দায় অস্বীকার করা যাবে না। তারা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ আমাদের বলেছে, চিনি উৎপাদনে যে চাপের গ্যাস প্রয়োজন, তারা তা পাচ্ছেন না। এ কারণে চিনির উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে সরবরাহ কম হচ্ছে। কোনো কোনো মিল মালিক বলেছেন, তারা আগের মতো চিনি আমদানির এলসি খুলতে পারছেন না। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণেও চিনির বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আমরা এসব কারণ তুলে ধরে তা সমাধানে ১১টি সুপারিশসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। চিনির বাজারে অস্থিরতার এ কারণগুলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকেও অবহিত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।যে সাত কারণে বেড়েছে চিনির দাম : চিনির বাজার অস্থিতিশীলতার জন্য যে কারণগুলো তুলে ধরেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, সেগুলো হলো- (১) গ্যাস সংকটের কারণে মিলে চিনির উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যাওয়া; (২) চিনি কেনাবেচার ক্ষেত্রে মুদ্রিত (পাকা) ভাউচার প্রদান না করায় প্রতিটি স্তরে মূল্য কারসাজির সুযোগ নেওয়া; (৩) অপরিশোধিত চিনি আমদানির এলসি খুলতে জটিলতা; (৪) মিলগেট থেকে ট্রাকে চিনি সরবরাহের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা; (৫) ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব (৬) চিনি আমদানিতে অত্যধিক শুল্কহার এবং (৭) অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ অনুযায়ী সরবরাহ আদেশে (এসও) চিনির একক মূল্য উল্লেখ না করা।
সংকট মোকাবিলায় ১১ সুপারিশ : চিনির বাজারে অস্থিরতা ঠেকাতে ১১টি সুপারিশ করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিফতর। এগুলো হলো- (১) মিলগুলোকে সর্বোচ্চ উৎপাদন ও সরবরাহ অব্যাহত রাখতে নির্দেশনা প্রদান; (২) মিল হতে খুচরা পর্যায়ে কোথাও চিনির অসাধু উদ্দেশ্যে মজুদ করে বাজার অস্থিতিশীল করছে কি না গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক তা নজরদারি করা; (৩) চিনির বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত মোবাইল কোর্ট/বাজার অভিযান অব্যাহত রাখা; (৪) মূল্য পর্যালোচনার জন্য মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির নিয়মিত সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া; (৫) চিনি উৎপাদনকারী মিলগুলোতে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা; (৬) মিল মালিক থেকে খুচরা পর্যায়ে পাকা ভাউচার নিশ্চিত করা; (৭) এলসি খোলার জটিলতা দূর করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করার নির্দেশনা প্রদান; (৮) মিলগেট হতে চিনি পরিবহনে (ট্রাক) অপেক্ষমাণ সময় কমিয়ে আনা; (৯) এলাকাভিত্তিক ডিলার নির্ধারণ করে সেই ডিলারদের মাধ্যমে এলাকার বাজারগুলোতে চিনির সরবরাহ নিশ্চিত করা; (১০) মিল কর্তৃক চিনির সরবরাহ আদেশে একক মূল্য উল্লেখ করা এবং (১১) ঢাকাসহ বড় বড় বাজারগুলোতে পাইকারি চিনি ব্যবসায়ীদের চাহিদামতো মিল হতে চিনি সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ।
মনিটরিংয়ের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা জানান, আমরা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে যাওয়ার পর তারা বলছেন, পাইকারি ব্যবসায়ীরা চিনি দিচ্ছেন না। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিলাররা বাজারে চিনি ছাড়ছেন না। আবার ডিলারদের কাছে যাওয়ার পর তারা বলছেন, মিলগেট থেকে সরবরাহ আদেশে নির্ধারিত সময় অনুযায়ী মিল মালিকরা চিনি ছাড় করছেন না। কর্মকর্তারা জানান, ডিলারদের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একটি মিলে দেখা গেছে, একাধিক সরবরাহ আদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ থেকে ১২ দিন পর চিনি সরবরাহ করা হয়েছে। ডিলাররা দাবি করেছেন, সরবরাহ আদেশের মেয়াদ অনুযায়ী চিনি ট্রাকে লোড না করায়, মিলগেটে অপেক্ষারত ট্রাককে প্রতিদিনের অতিরিক্ত ভাড়া পরিশোধ করতে হয়েছে। ফলে এই অতিরিক্ত খরচ চিনির দামে যুক্ত হয়েছে, যার জন্য প্রকৃত অর্থে মিল মালিকরাই দায়ী।