বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

কী হচ্ছে বিআরটি প্রকল্পে

টঙ্গী-গাজীপুর সড়কের অবস্থা ভয়াবহ । এমন যানজট কেউ দেখেনি কোনো দিন

শিমুল মাহমুদ ও আফজাল, টঙ্গী

কী হচ্ছে বিআরটি প্রকল্পে

ধীরগতির কাজের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বেহাল পড়ে আছে টঙ্গী-গাজীপুর সড়ক -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৩৫-৪০ মিনিটে গাজীপুর যাওয়ার আকাক্সক্ষায় দেশের প্রথম বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের সূচনা হয়েছিল ২০১২ সালে। ১০ বছরেও সেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। উপরন্তু বিমানবন্দর থেকে টঙ্গী-গাজীপুর সড়ক নিত্যদুর্ভোগের অনুসঙ্গী হয়ে উঠেছে। টঙ্গী-গাজীপুর সড়ক এখন হাজার হাজার যাত্রী ও পরিবহন কর্মীর আতঙ্কের নাম। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। বিভিন্ন অজুহাতে প্রকল্পের ডিপিপি এ পর্যন্ত চার দফা সংশোধন করা হয়েছে। সময় বাড়ানো হয় চলতি ২০২২ সাল পর্যন্ত। কিন্তু চলতি বছরেও এর নির্মাণকাজ শেষ হচ্ছে না। ১০ বছরে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারলেও এখন আবার ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এক বছর সময় বাড়ানো হচ্ছে। তবে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা এর কাজ কবে শেষ হবে তার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণও বলতে পারছেন না। বিআরটি প্রকল্পের বিশৃঙ্খল নির্মাণকাজের কারণে পুরো রাস্তার বিভিন্ন অংশে গর্ত খুঁড়ে, বেষ্টনী দিয়ে এমন অবস্থা করা হয়েছে যাতে যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৮৫ শতাংশ।

ঢাকা-গাজীপুর রুটের একাধিক পরিবহনকর্মী জানান, তীব্র যানজটের কারণে তাদের ট্রিপসংখ্যা কমে গেছে। কোনো কোনো দিন দুটির বেশি ট্রিপ দেওয়া যায় না। ফলে সারা দিন গাড়ি চালিয়ে তেলের খরচও ওঠে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ সড়কে বাস চালানো বন্ধ করে দিতে হবে। এদিকে যানজটের কারণে এ সড়কের একাংশ দিয়ে চলাচল নিরুৎসাহ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। উত্তরা হয়ে গাজীপুর সড়ক ব্যবহার না করার অনুরোধ জানিয়ে যাত্রীদের সতর্ক করেছে ডিএমপি। জরুরি ছাড়া রাজধানীর খিলক্ষেত-উত্তরা হয়ে গাজীপুরমুখী সড়ক ব্যবহার না করতে অনুরোধ জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক উত্তরা বিভাগ। যানজট ও অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা এড়াতে এ অনুরোধ জানিয়েছে তারা। মঙ্গলবার ডিএমপির মিডিয়া ও পাবলিকেশন্স বিভাগ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ অনুরোধ জানানো হয়েছে। ডিএমপি বলেছে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাত হওয়ায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরের বিভিন্ন অংশে বড় বড় গর্তে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে খিলক্ষেত-উত্তরা হয়ে গাজীপুরমুখী যান চলাচল মারাত্মক বিঘিœত হচ্ছে।

বিআরটি প্রকল্পের দুরবস্থার কারণে ঢাকা-গাজীপুর সড়কটি নিয়মিত যানজটের সড়কে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো দিন যানজটের তীব্রতা বাড়লে মহাখালী, বনানী এবং ফ্লাইওভার পেরিয়ে কুড়িল-বাড্ডায় যানজট ছড়িয়ে পড়ে। সড়ক ব্যবহারকারীরা বলছেন, ৩২ জেলার যানবাহনের গেটওয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের একাংশ টঙ্গী-গাজীপুর সড়ক এখন ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের অন্য নাম। বিভিন্ন জেলার লাখ লাখ মানুষ এ সড়কের ওপর দিয়ে যাতায়াত করছে প্রতিদিন। অথচ বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণকাজের বিড়ম্বনায় আর সড়ক-মহাসড়কে খানাখন্দের কারণে মানুষকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলাগামী পরিবহন টঙ্গীতে এসেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকছে। বছরের পর বছর ধরে এমন অবস্থা যেন উন্নয়নের নামে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবে নাগাদ শেষ হবে এ প্রকল্পের কাজ এর কোনো সঠিক তথ্য জানা নেই কারও। এ প্রকল্পের অব্যবস্থাপনায় হতাশ যাত্রী ও পরিবহনকর্মীরা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণেই এ ভয়াবহ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে।

সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মহাসড়কের টঙ্গীসহ বিভিন্ন স্থানে বিআরটি প্রকল্পের খোঁড়াখুঁড়ি ও সড়কে খানাখন্দ, জলাবদ্ধতার কারণে দীর্ঘদিন যানজটের কবলে পরিবহন যাত্রীরা। মহাসড়কে টঙ্গীর বিভিন্ন স্থানে গর্ত ভরাট করা হচ্ছে লাল মাটি দিয়ে। এতে সড়কে গাড়ি চলতে গিয়ে দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি এসব রাস্তা সংস্কারে অনিয়মের কারণে কয়েক মাসের মধ্যেই আবারও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে সড়কটি। সংস্কার করা রাস্তায় ইট-পাথরের কোনো অস্তিত্বই এখন নেই। সামান্য বৃষ্টির পানিতে সব ধুয়েমুছে গেছে মনে হয়। যে কারণে বড় বড় গর্ত ভরাট করা হচ্ছে মাটি দিয়ে। রাস্তার দিকে তাকালে মনে হয় খাল কিংবা ছোট নদী। এ রাস্তা কিংবা উড়ালসড়ক নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে আর কত সময় লাগবে তা নিয়ে জনমনে নানা সমালোচনা চলছে। এ ছাড়া মহাসড়কের পাশাপাশি শাখা সড়কগুলোও খানাখন্দে ভরে গেছে।

টঙ্গী শিল্প এলাকায় অবস্থিত এক কারখানার কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘জ্যামের কারণে গাড়িতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করতে হচ্ছে।’ টঙ্গীর মরকুন এলাকার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘জ্যামের ভয়ে বাসা থেকেই বের হই না। এ জ্যামের কারণে মানুষের যে কী কষ্ট তা বলা মুশকিল।’

ট্রাফিকের (দক্ষিণ) সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. ফয়জুল ইসলাম বলেন, ‘টঙ্গী আফতাব সিএনজি পাম্পের সামনে থেকে শুরু করে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশে বৃষ্টির পানি জমে খানাখন্দে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিআরটি প্রকল্পের খোঁড়াখুঁড়ি। যে কারণে গাড়ি ঠিকমতো চলাচল করতে পারছে না। আস্তে আস্তে জ্যাম বাড়তে শুরু করে।’

বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক মো. মহিউল ইসলাম বলেন, ‘টঙ্গী মিলগেট এলাকায় পশ্চিম পাশের রাস্তা প্রশস্ত করা হচ্ছে। আশা করি মিলগেটে এলাকা দিয়ে দু-তিন লেনে গাড়ি চলতে পারবে। তখন আর কোনো সমস্যা হবে না। অন্যদিকে পুব পাশে আফতাব সিএনজির সামনে থেকে শুরু করে স্টেশন রোড পর্যন্ত নতুন করে রাস্তা নির্মাণ হবে, যে কারণে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হচ্ছে। তবে প্রচ- ঝড়ের কারণে আমরা এক সপ্তাহ পিছিয়ে পড়েছি। আশা করি এক-দুই দিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে। তা ছাড়া বর্ষা-বৃষ্টির কারণে আমরা কাজ করতে পারছি না। জ্যামের কারণে মানুষের কষ্ট হচ্ছে, এটা আমরা বুঝতে পারি কিন্তু করার কিছুই নেই। আমরা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিটিং করেছি, যাতে দ্রুত কাজ শেষ করা যায়।’

উল্লেখ্য, গত আগস্টে প্রকল্পের কাজ চলার সময় প্রাইভেট কারে ক্রেন থেকে ভায়াডাক্টের অংশ ছিটকে পড়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়। এরপর বিআরটি প্রকল্পের নিরাপত্তাহীন নির্মাণকাজ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। নির্মাণসামগ্রী পড়ে এর আগেও একাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও প্রকল্পকাজের ধীরগতিতে ক্ষুব্ধ। ১৬ অক্টোবর সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে এ প্রকল্পের সাফল্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, ‘একটা প্রকল্প আমাদের গলার কাঁটা হয়েছে। সেটি হলো বাস র?্যাপিড ট্রানজিট। এটা আমি আসার আগেই নেওয়া হয়েছিল। এ প্রকল্প কতটা বাস্তবসম্মত ছিল, তাতে ভাবনার ঘাটতি ছিল।’ প্রকল্পটির নির্মাণকাজ চলাকালে ঢাকার উত্তরা ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের যানজট পরিস্থিতি নাজুক হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ মূল্যায়ন করছেন মন্ত্রী।

যা আছে বিআরটি প্রকল্পে : রাজধানীর যানজট লাঘবে দ্রুতগতির গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ২০১১ সালে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত নির্দিষ্ট লেনে শুধু বাস চলাচলের জন্য বিআরটি প্রকল্পটি হাতে নেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর। ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পের আর্থিক সহযোগিতায় এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটির ঋণ হচ্ছে ১ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। বাকি অর্থায়ন সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। দফায় দফায় সময় বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পের সর্বশেষ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায়। ১০ বছরে ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের জন্য ১ দশমিক ৯০ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও বাস মালিকদের ক্ষতিপূরণ ছাড়াও ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার ডেডিকেটেড বাস লেন নির্মাণ, ১০ লেনবিশিষ্ট টঙ্গী সেতু, ৪ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এলিভেটেড সড়ক, বিমানবন্দর ইন্টারসেকশনে ৫৫০ মিটারের আন্ডারপাস, ছয়টি ফ্লাইওভার, একটি বাস ডিপো, উভয় পাশে ১২ কিলোমিটার করে ড্রেন নির্মাণের কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া যাত্রীবহনে ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস (জোড়া বাস) কেনার উল্লেখ রয়েছে। নতুন করে সংশোধন প্রকল্পে ১৩০টি আর্টিকুলেটেড বাস কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর