প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, রিজার্ভের টাকা গেল কোথায়? অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন রিজার্ভের টাকা কেন খরচ হচ্ছে? যারা এই প্রশ্নগুলো তোলেন তাদের বলছি, রিজার্ভের টাকা গেল পায়রা বন্দরে। রিজার্ভের টাকা গেছে মানুষের খাদ্য কেনায়, সার কেনায়। মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য। এটাকে (রিজার্ভ) কেউ চিবিয়ে খায়নি। গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রী সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকা পটুয়াখালী জেলার পায়রায় যুক্ত হয়ে ১১ হাজার ৭২ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন। প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, পায়রা সমুদ্রবন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ আটটি জাহাজের উদ্বোধন, প্রথম টার্মিনাল ও ছয় লেনের সংযোগ সড়ক, বন্দরের ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং একটি সেতু নির্মাণ। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহাইল অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর ওপর অনুষ্ঠানে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। দেশের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে রিজার্ভের অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, নিজস্ব এই অর্থ দিয়েই পায়রা সমুদ্রবন্দরের উন্নয়নকাজ করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই টাকা দিয়েই যেহেতু প্রথম কাজটি আমরা শুরু করলাম, ভবিষ্যতে এভাবেই নিজেদের রিজার্ভের টাকা, এই টাকাও আমরা আমাদের অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি। সেটা আমরা বন্দরকে লোন দিয়েছি খুব অল্প সুদে। ১ শতাংশ সার্ভিস চার্জ বাদে ২ শতাংশ তাদের দিতে হবে।
বাংলাদেশকে রক্ষায় শতবর্ষ মেয়াদি ডেল্টা প্ল্যান গ্রহণের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর ফলে উন্নয়নটা হবে সুষম উন্নয়ন। সব অঞ্চলের মানুষ সমানভাবে উন্নত জীবন পাবে। প্রতিটি গ্রামে যারা বাস করে তারা নাগরিক সুবিধা পাবে। আমার গ্রাম আমার শহরে পরিণত হবে। সারা বিশ্বের অগণিত সাধারণ মানুষের কথা ভেবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করে, আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জোর আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, হঠাৎ করে সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। একদিকে করোনা মহামারি, অতিমারির প্রভাব। এরপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সেই সঙ্গে স্যাংশান। যার ফলে আজকে সারা বিশ্বের সাধারণ মানুষ ভুক্তভোগী। তারা কষ্টে আছেন।শেখ হাসিনা বলেন, এই যুদ্ধে কারা লাভবান হচ্ছে জানি না। হয়তো লাভবান হচ্ছেন, যারা অস্ত্র ব্যবসা করেন বা অস্ত্র বানান। শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এই যুদ্ধটা বন্ধ করতে হবে, স্যাংশান প্রত্যাহার করতে হবে। মানুষকে বাঁচার সুযোগ দিতে হবে, জীবনমান ধরে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, মানুষ বাঁচুক, সুন্দরভাবে বাঁচার সুযোগ করে দেওয়া হোক, এই অস্থিরতা বন্ধ হোক। যেন শান্তির সুবাতাস বয়ে যেতে পারে, মানুষের জীবনমান উন্নত হতে পারে, সেটাই আমরা চাই। শেখ হাসিনা বলেন, পায়রা বন্দর তৈরি করার চিন্তা-ভাবনা যখন করি অনেকেই বাধা দিয়েছেন। বলেছেন, সেখানে বন্দর হওয়া সম্ভব নয়। কারণ এখানে অনেক সিলড আছে। বিশেষ করে আমাদের রামনাবাদ চ্যানেল আন্ধারমানিক নদ এখানে এত বেশি সিলড, যেগুলো অপসারণ করে খুব বেশি নৌ চলাচলের সুযোগ করা যাবে না। কিন্তু আমার একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। কারণ আমি নিজেই এসব অঞ্চল অনেক ঘুরেছি। প্রতিটি নদীতে স্পিড বোটে করে আমি বিভিন্ন চরগুলোতে গিয়েছি, দেখেছি। তখন থেকে আমার একটা ইচ্ছা ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে সব সময় শুনতাম এ অঞ্চলের কথা। আমার বাবার মুখে শোনা, কাজেই তখন থেকে আমার চিন্তা এখানে একটা বন্দর আমাদের হওয়া দরকার বা ওই অঞ্চলে। এর মধ্যে পায়রা বন্দরে ২৬০টি বৈদেশিক বাণিজ্যের জাহাজের আগমনে ৬১৩ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আয় হওয়ায় আনন্দিত প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, রামনাবাদ চ্যানেলে যে গভীরতা সেটা ৬ দশমিক ৩ মিটার ধরে রাখার জন্য ইতোমধ্যে মেইনটেন্যান্স ড্রেজিংয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে, যা এখনো স্থিতিশীল আছে। অনেকের ধারণা ছিল ড্রেজিং করে দিলে পরে আবার পুনরায় সিলড হয়ে যাবে। আমার কথা হচ্ছে, এটা আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে যখনই আমরা কোনো ড্রেজিং করব আমাদের প্রথমে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে হবে এবং প্রতি বছর আমাদের মেইনটেন্যান্স ড্রেজিং করতে হবে। তাহলে আমাদের নৌপথগুলো সচল রাখা সম্ভব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পায়রা বন্দরের সক্ষমতাকে নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চ্যানেলটিতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ড্রেজিং কাজ। এর ফলে বন্দর থেকে সাগরের মধ্যে ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ১০০ থেকে ১২৫ মিটার প্রশস্ত এবং কমবেশি ১০ দশমিক ৫০ মিটার গভীরতার চ্যানেল সৃষ্টি হবে। এতে বন্দরে ৩০০০ টিইইউ বা ৪০ থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন কার্গো বহনক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজ ভেড়ানোর সক্ষমতা এই বন্দর অর্জন করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রামনাবাদ চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও মেইনটেন্যান্স ড্রেজিংয়ের কাজে সহযোগিতা করছে বেলজিয়ামভিত্তিক বিশ্বখ্যাত একটি ড্রেজিং কোম্পানি। এ জন্য বেলজিয়াম সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এটা কিন্তু প্রতি বছরই ড্রেজিং করতে হবে। এ জন্য পায়রা বন্দরের জন্য নিজস্ব ড্রেজার সংগ্রহ করতে হবে। প্রত্যেক বন্দরের জন্য আলাদা নিজস্ব ড্রেজারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমাদের মোংলা বন্দরেও নিজস্ব ড্রেজার ছিল না। আমি মনে করি, ড্রেজার রাখা দরকার। কারণ প্রতি বছরই মেইনটেন্যান্স ড্রেজিংটা আমাদের নিয়মিতভাবে করে যেতে হবে। ড্রেজিং হয়ে গেলে নৌপথটা উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাশাপাশি এর মাধ্যমে আসাম এবং ভুটান পর্যন্ত কিন্তু নৌপথ চালু হতে পারে। আমরা যেমন আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর ও মোংলা বন্দর ভুটান, নেপাল ও ইন্ডিয়াকে ব্যবহার করবার জন্য তাদের সুযোগ দিয়েছি। পায়রা বন্দরটাও কিন্তু একসময়, যেহেতু এটির একপাশে মোংলা, এক পাশে চট্টগ্রাম বন্দর, ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় হচ্ছে পায়রা বন্দর। ফলে এটি কিন্তু অন্য ধরনের একটা গুরুত্ব বহন করবে। সেটা সবাইকে মনে রাখতে হবে।
নদীমাতৃক দক্ষিণাঞ্চলে মাটির কারণে রেল যোগাযোগ তৈরি করা কষ্টসাধ্য জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তবুও এটার ওপর সীমাক্ষা চলছে।