চিকিৎসার জন্য বাড়ছে বিদেশমুখী রোগীর ভিড়। ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দূতাবাসে মেডিকেল ভিসার জন্য যাওয়া মানুষের ভিড় বাড়ছে। দেশের সরকারি হাসপাতালে রয়েছে অব্যবস্থাপনা, সংকট, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা। বেসরকারিতে রয়েছে মানের ঘাটতি, আস্থার সংকট, প্রতারণার ফাঁদ। উচ্চবিত্তের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতাকে এসব কারণ আরও উসকে দিচ্ছে। ভালো সেবার আশায় মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষও ছুটছে বিদেশে। জানা যায়, উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। ক্যান্সার, কিডনি, হার্ট ও লিভার জটিলতার রোগীরা চিকিৎসার জন্য ছুটছেন বিদেশে। ভারতে যাওয়া রোগীর ভিড় সবচেয়ে বেশি। মধ্যবিত্ত ক্যান্সার রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভারতে যান। কলকাতা, মুম্বাই, চেন্নাইয়ে বাংলাদেশি রোগীর ভিড় চোখে পড়ার মতো। ঢাকা-চেন্নাই ফ্লাইটের সিংহভাগ যাত্রীই চিকিৎসার জন্য রওনা হন। নানা ধরনের রোগের প্রকোপ বাড়ছে, রোগী বাড়ছে কিন্তু ভালো মানের হাসপাতাল গড়ে উঠছে না। বেসরকারি পাঁচ তারকা হাসপাতালগুলোয় রোগীর ভিড়ে প্রায়ই শয্যাসংকট দেখা দেয়। গত দুই বছর কভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে বিদেশযাত্রায় ছিল নানা বিধিনিষেধ। ভারতের সঙ্গে স্থলপথে সীমান্ত দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় যেতে পারেননি রোগীরা। সীমান্ত খুলতেই মেডিকেল ভিসা আবেদনের ভিড় বেড়েছে ভিসা কেন্দ্রগুলোয়। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে যাওয়া রোগীর ভিড়ও ঊর্ধ্বমুখী।
বিদেশগামী রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় বিষয়ে সরকারি সংস্থার গবেষণা নেই। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশি চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান। এর অধিকাংশই ভারতে যান। এ ছাড়া অনেকে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় যান। অল্প কিছু মানুষ ইউরোপ ও আমেরিকায় যান। এতে ব্যয় হয় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারতে এক বছরে প্রায় ২২ লাখ বাংলাদেশি ভ্রমণ করেছেন। এর বড় অংশ চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। সম্প্রতি ভারত থেকে চিকিৎসা করিয়ে ফিরেছেন অনীতা সাহা (৫২)। তিনি বলেন, ‘প্রস্রাবে জ্বালাপোড়াসহ কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ায় গাজীপুরে আমি এক চিকিৎসকের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে কিছু টেস্ট করতে দেন। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বলেন জরায়ুমুখের ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এ কথা শোনার পর আমি আরেকজন ডাক্তারের কাছে যাই। সেই ডাক্তার তো কেমোথেরাপি শুরু করতে বলেন। পরে আমি আমার প্রতিবেশীর সহযোগিতায় ভারতে গিয়ে টেস্ট করিয়ে চিকিৎসা করাই। তারা টেস্ট করে বলেন, জরায়ুমুখের ক্যান্সারের কোনো জীবাণু নেই আর ক্যান্সার হওয়ার কোনো লক্ষণও নেই। ক্যান্সারের কথা শোনার পর থেকে আমি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলাম। দুশ্চিন্তার কারণে ওষুধ খেলেও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসত না। এখন শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো আছি।’ বাথরুমে পিছলে পড়ে হাত ভেঙে গিয়েছিল মারুফুর রহমানের (৪২)। তিনি বলেন, ‘পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেলে এক্স-রে করিয়ে উত্তরায় একজন সার্জনের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি এক্স-রে দেখে বললেন আমার হাতে অপারেশন করে স্টিলের পাত বসাতে হবে। চার দিন কেবিনে থাকাসহ বিভিন্ন খরচ বাবদ প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার ফর্দ ধরিয়ে দিলেন। আমি আমার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ভিসা করিয়ে থাইল্যান্ড যাই। আমার এই বন্ধুও থাইল্যান্ডে এর আগে চিকিৎসা করিয়েছেন। সেখানে হাসপাতালে গেলে তারা আগের ব্যান্ডেজ কেটে প্রযুক্তির সাহায্যে হালকা কিছু চিকিৎসা করে পুনরায় ব্যান্ডেজ করে দেন। মাত্র দুটি ওষুধ দিয়েছিলেন। ব্যান্ডেজ কাটার পর কিছু ব্যায়াম করতে বলেছিলেন। আমার হাত এখন পুরোপুরি ঠিক। আমি সব ধরনের কাজ করতে পারি। অথচ আমার ডান হাতে স্টিলের পাত বসিয়ে দিলে হাতটি পুরোপুরি অকেজো হয়ে যেত। সেখানে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহার খুব আন্তরিক। অথচ দেশের হাসপাতালে দায়িত্বরত লোকজনের ব্যবহার দেখলেই মন বিগড়ে যায়।’
বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণকারী বেশ কয়েকজন রোগীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দেশের চিকিৎসাসেবার ওপর তাদের আস্থা নেই। ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আর চিকিৎসাসেবায় রয়েছে সংকট। চিকিৎসক ও নার্সদের আচরণ রোগীবান্ধব নয়। এ দেশে ক্যান্সার, নিউরো, কিডনি, লিভারসহ কিছু জটিল অসংক্রামক রোগের পূর্ণাঙ্গ বা চূড়ান্ত পর্যায়ের নির্ভরযোগ্য চিকিৎসাসেবা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোগীর সর্বোত্তম সেবা ও নিরাপত্তা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার প্রধান কাজ। তবে বাংলাদেশের অনেক হাসপাতালে রোগীদের সেবার চেয়ে ভোগান্তিই পোহাতে হয় বেশি। প্রয়োজন না থাকলেও দীর্ঘ সময় রাখা হয় আইসিইউতে। এর ওপর লাইসেন্সবিহীন নামসর্বস্ব হাসপাতালে অপচিকিৎসা তো রয়েছেই। হৃদরোগীদের হার্টের রিং পরাতে চলে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মনকষাকষি। কিডনি, লিভার প্রতিস্থাপনে রয়েছে নানা জটিলতা। সরকারি হাসপাতালে শয্যাসংকট, বেসরকারি হাসপাতালের লম্বা সিরিয়াল এবং অব্যবস্থাপনা রোগীদের বিদেশমুখী হতে বাধ্য করে। ঢাকার বাইরে সরকারি হাসপাতালগুলোয় নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা। বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় এসে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায় রোগীদের জন্য। সরকারি হাসপাতালে একটা শয্যার ব্যবস্থা করতে গলদঘর্ম অবস্থায় পড়তে হয় রোগীর স্বজনদের। কেবিনের ব্যবস্থা করা তো রীতিমতো সোনার হরিণ পাওয়ার মতো বিষয়।সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ আগেও ছিল এখনো আছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু রোগীর ভোগান্তি কমছে না। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা, নিয়ম-শৃঙ্খলা, রোগীর সঙ্গে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের খারাপ আচরণ নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে ঘটছে মারধরের ঘটনা। কখনো রোগীর স্বজনরা মেরে আহত করছেন চিকিৎসককে, আবার কখনো ইন্টার্ন চিকিৎসকরা মিলে পিটুনি দিচ্ছেন রোগীর স্বজনদের। প্রায়ই ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। হাসপাতালে গিয়ে সেবা না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ। রোগীর অনুপাতে দেশে হাসপাতালে শয্যা ও চিকিৎসক সংখ্যায় বিশাল ফারাক। হাসপাতালের মেঝেতে থাকছেন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা। ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের পাশের একটি ভবনের বারান্দায় দেখা যায়, গাদাগাদি করে থাকছেন ২০ জন মানুষ। এর মধ্যে রোগী আছেন সাতজন। রাজধানীতে থাকার জায়গা নেই। হোটেলে ভাড়া দিয়ে থাকার সামর্থ্য নেই তাদের। কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য নিয়মিত আসতে হয় রোগী নিয়ে। হাসপাতালে দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে সিরিয়াল পাওয়ার জন্য আগে থেকেই এসে অপেক্ষা করছেন তারা। মাদারীপুর থেকে আসা রোগীর স্বজন মোক্তাদির হোসেন বলেন, ‘আমার চাচি ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত। এক বছর ধরে কেমোথেরাপি চলছে। আমাদের ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। এই ক্যান্সার ইনস্টিটিউটই শেষ ভরসা।’ আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ংয়ের (ইওয়াই) প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া রোগীর ৬২ শতাংশই অসংক্রামক নানা ব্যাধির (এনসিডি) চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। রোগীদের বিদেশমুখী স্রোত শুরু হলেও দেশের সেবার মান উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেই। করোনাভাইরাস মহামারিতে ফুটে উঠেছিল দেশের স্বাস্থ্যসেবার ভঙ্গুর চিত্র। রোগে আক্রান্ত হলে উচ্চবিত্তরা যান সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। আর মধ্যবিত্তরা সাধ্যের মধ্যে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করান। প্রতি বছর বিদেশ গিয়ে স্বনামধন্য চেইন হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। দেশের স্বাস্থ্যসেবার অব্যবস্থাপনা ও আস্থাহীনতায় বিদেশমুখিতা ঊর্ধ্বমুখী। এ হাসপাতালগুলোর শাখা দেশে খোলার ব্যাপারে নেই কোনো উদ্যোগ। দেশে মাত্র দুটি চেইন হাসপাতাল ‘এভারকেয়ার’ ও ‘এএফসি হেলথ ফরটিস হার্ট ইনস্টিটিউট’। রাজধানীতে এভারকেয়ারের একটিই শাখা। চট্টগ্রাম, খুলনা ও কুমিল্লায় রয়েছে এএফসি হেলথ ফরটিস হার্ট ইনস্টিটিউটের শাখা। ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি থাকলেও মানসম্পন্ন সেবা দিতে চেইন হাসপাতাল গড়ার আগ্রহ দেখা যায় না। বেসরকারি বিনিয়োগ না থাকায় সেবার মান বাড়ানো নিয়ে কোনো সুস্থ প্রতিযোগিতা নেই।