বিগত ২০১৩-১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোলবোমা হামলা ও হামলা-পরবর্তী দুর্বিষহ দিনের বর্ণনা করতে গিয়ে আহত ব্যক্তি ও স্বজন হারানো পরিবারের সদস্যরা কাঁদলেন, কাঁদালেন সবাইকে।
চাইলেন বিচার। রাজধানীর জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে গতকাল আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘অগ্নিসন্ত্রাসের আর্তনাদ : বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খন্ডচিত্র’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা দুঃখ-দুর্দশার কথা বলেন। আক্রান্ত ও নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে নিজের আবেগ ও অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বারবার অশ্রুসজল প্রধানমন্ত্রীকে নিজের চশমা খুলে কান্নাভেজা চোখ মুছতে দেখা যায়। মিলনায়তন জুড়ে সৃষ্টি হয় এক বেদনাবিধুর পরিবেশ। এ অনুষ্ঠানে ক্ষতিপূরণ ও বিচার চাইলেন পঁচাত্তর-পরবর্তী সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের সময়ে সামরিক আদালতে দন্ডিত বিমান বাহিনীর সদস্যদের পরিবারের সদস্যরাও। সাধারণত কোনো অনুষ্ঠানে মূল মঞ্চে রাখা হয় প্রধান অতিথি ও অতিথিদের আসনের ব্যবস্থা। কিন্তু গতকালের অনুষ্ঠানটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ২০১৩-১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোলবোমা ও অগ্নিসন্ত্রাসে ক্ষতিগ্রস্তরাই ছিলেন মূল মঞ্চে। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিক, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন দর্শক সারিতে। মঞ্চে উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে পেট্রোলবোমা হামলায় কেউ হারিয়েছেন স্বামী, কেউ সন্তান। আবার কেউ হামলার শিকার হয়ে চিকিৎসা করতে গিয়ে আয়রোজগারের অক্ষমতায় হয়েছেন নিঃস্ব। কেউবা হামলার শিকার হয়ে হারিয়েছেন চাকরিও। আবার কেউ হারিয়েছেন জিয়ার সামরিক আদালতের বিচারে দন্ডিত জন্মদাতা পিতাকে। রাজধানীতে বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোলবোমা, অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়ে আহত হন সালাউদ্দিন ভূইয়া। সেদিনের স্মৃতি স্মরণ করে তিনি বলেন, আমি ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে একটি দোকানে কাজ করতাম। কাজ শেষে বাসায় ফেরার জন্য বাসে রওনা দিই। আমাদের বাস যাত্রাবাড়ী পৌঁছলে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে। পেট্রোলবোমা হামলায় আমার মুখ ও হাত পুড়ে যায়। সালাউদ্দিন বলেন, আমি খুব সুদর্শন ছিলাম, যেখানে চাকরির জন্য যেতাম কাজ পেতাম। এখন আমাকে দেখে কেউ কাজ দেয় না। আমার কাজ করার শক্তি আছে, কিন্তু কেউ কাজ দেয় না। আমার পাশে কেউ বসে না। সবাই ভাবে আমি পাগল। আমার মনে অনেক কষ্ট... বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন সালাউদ্দিন। এরপর আবার বলেন, আজকে মানবতার মা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দেখে আমার সব দুঃখ ভুলে গেছি। তিনি বলেন, আমার দুই ছেলে, এবার তারা এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের একটা কিছুর ব্যবস্থা করুন। আমাকে একটু কাজের ব্যবস্থা করে দিন। তিনি বলেন, আমরা আর জামায়াত-বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না। কারণ তারা দেশের মানুষকে পুড়িয়ে মারে। পেশায় গাড়িচালক রমজান আলী। ৩৮ বছর ধরে কাভার্ড ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। ২০১৩ সালের কোনো একদিন ঢাকা থেকে মালামাল নিয়ে রওনা হলেন গাজীপুরের পথে। সঙ্গে ১৪ বছরের ছেলে মনির হোসেন। গাজীপুরে পৌঁছে একটি স’মিলের পাশে গাড়িটি পার্ক করে রাখেন রমজান। গাড়িতে তখন মনির ঘুমাচ্ছিল। বাবা রমজান ভাবলেন, ছেলেকে একটি অটোরিকশায় করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেই ভালো হয়, কিন্তু অটোরিকশা ডাকার প্রস্তুতির মধ্যেই তিনি দেখতে পেলেন দাউদাউ করে জ্বলছে তার কাভার্ড ভ্যান। পেট্রোলবোমা কেড়ে নিয়ে যায় তার আদরের ধন। সন্তানহারা রমজান বলেন, ‘আমি তো রাজনীতি করি না। আমি তো খেটে খাওয়া মানুষ। আমার চোখের সামনে আমার ছেলেকে পেট্রোলবোমার আগুন জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিল, কিন্তু আমি সন্তানকে বাঁচাতে পারলাম না। এর চেয়ে কষ্ট আর নেই।’ ওই সময় দর্শক আসনে বসে থাকা প্রধানমন্ত্রীকেও কাঁদতে দেখা যায়। নিজ সন্তান হত্যায় যারা দায়ী, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের বিচার চাইলেন রমজান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের মায়ের মাথায় আপনি একটু হাত বুলিয়ে দেন।’ রমজানের স্ত্রীকে নিয়ে আসা হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। ২০১৩ সালে মাদারীপুর থেকে ঢাকা আসার পথে আগুনে পুড়ে মারা যায় ১৭ বছরের নাহিদ। তার মা রুনি বেগমও যোগ দিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানকে দেখতে পারি নাই, দেখার সুযোগ পাইনি বিএনপি-জামায়াতের কারণে।’ সন্তানহারা মা আর্তনাদ করে বলেন, ‘সন্তান হত্যার বিচার পাইনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই। আপনে আমার মা, আমি আপনার সন্তান। আমার সন্তান হত্যার বিচার আপনে করবেন। আমার মায়ের কাছে অনুরোধ করতে পারি।’ রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবিলায় রাজধানীর কাঁচপুরে দায়িত্ব পালন করছিলেন বিজিবির সুবেদার নায়ক শাহ আলম। তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার আলেয়া বলেন, ওই সময় বিএনপি-জামায়াতের একটি মিছিল যাচ্ছিল। কোনো উসকানি ছাড়াই শাহ আলমকে সাপের মতো পিটিয়ে মারা হয়। বুকভরা বেদনা নিয়ে শাহ আলমের স্ত্রী নাসরিন আক্তার আলেয়া বলেন, ‘তাকে জামায়াতের সন্ত্রাসীরা এমনভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে, যা মানুষ করতে পারে না। এরা মানুষ না, জানোয়ার, কেমন সন্ত্রাসী, তা শুধু তারাই বলতে পারে।’ ‘যতদিন বেঁচে থাকব এই যন্ত্রণা কখনো ভুলতে পারব না’- উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে স্বামীহারা এই নারী বলেন, ‘আমার স্বামী তো রাজনীতি করে নাই। তার তো কোনো অপরাধ ছিল না। সে তো দেশের কাজে নিয়োজিত ছিল। তাকে কেন এভাবে হত্যা করা হলো?’ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আকুতি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে, তাদের কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি চাই। আমি চাই আমার মতো কোনো নারী যেন এই বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের হাতে স্বামীকে হারিয়ে বিধবা না হয়। কোনো সন্তান যেন পিতৃহারা না হয়।’ আলেয়া যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন প্রধানমন্ত্রীকে খুব ভারাক্রান্ত দেখাচ্ছিল। ট্রাক ড্রাইভার রফিকুল ইসলাম ঢাকা থেকে মালামাল নিয়ে ছুটলেন ঠাকুরগাঁওয়ের পথে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ রফিকুল পৌঁছালেন দিনাজপুরের কাহারুল থানার ভাঁদগাওয়ে। সেখানেই চারদিক থেকে তাকে পেট্রোলবোমা ছোড়া হয়। পুড়ে যায় রফিকুলের গোটা শরীর। মৃত্যু গহ্বর থেকে বেঁচে ফিরলেও সারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই ক্ষত। তিনি বলেন, ‘সন্তানের মুখে খাবার ও লেখাপড়ার খরচ দিতে পারি না বলেই সেদিন গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলাম।’ সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রফিকুল। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে বাঁচাও। আমার চারটি মেয়ে, কোনো ছেলে নেই। এই যে জামায়াত-বিএনপি, এত জঘন্য! কাঁদতে কাঁদতে রফিকুল বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি এর বিচার চাই।’ ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ। রাজশাহীর বোয়ালিয়ার সাহেববাজারে পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন সাব ইন্সপেক্টর মকবুল হোসেন। তার দিকে ছোড়া হলো হাতবোমা। মুহূর্তে উড়ে গেল দুটি হাত। সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত। মকুবল বলেন, ‘পুলিশের সদস্য হিসেবে গর্বিত। মানুষের সেবায় নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও কার্পণ্য করি না। আমি আহত হয়েছি, পঙ্গুত্ববরণ করেছি, কিন্তু মনোবল হারাইনি।’ এখনো কিছু জামায়াতের পক্ষের সাংবাদিকরা তার পেছনে লেগে আছে বলে অভিযোগ করেন মকবুল। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে নামে-বেনামে পুলিশ সদও দপ্তরে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। মকবুল আরও বলেন, ‘আমাকে হয়রানি করছে। আমার পদোন্নতি বন্ধ করে দিয়েছে, কিন্তু আমি মনোবল হারাইনি।’ পুলিশ কনস্টেবল জাকারিয়াকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। জাকারিয়ার স্ত্রী মায়া বেগম বলেন, আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। আমার দুটি ছেলে আছে, তাদের একটা ব্যবস্থা করবেন। আমার সুস্থতার ব্যবস্থা করবেন। ফটো সাংবাদিক আবু সাঈদ তামান্না সেদিনের স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, সেদিন আমি মৃত্যুর মুখে পড়ে যাই। আমার কাছে একটা ফোন আসে যে তারা পেট্রোলবোমা বিতরণ করছে। তারা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তাড়া করে ছুরিকাঘাত করে। আমরা কাজের সুন্দর পরিবেশ চাই। বিএনপি-জামায়াত এখন আবার শুরু করেছে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। স্বামীহারা বিনা সুলতানা বলেন, ২০১৩ সালের ৪ নভেম্বর পেট্রোলবোমা হামলায় আমার স্বামী মারা যান। আমার দুটিা সন্তান আছে। আমার সন্তানদের বাঁচাতে গার্মেন্টে কাজ শুরু করি। আমি ১৪-১৫ ঘণ্টা ডিউটি করে সন্তানদের বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার সন্তানরা কী অপরাধ করেছে? আমার সন্তানরা স্কুলে গিয়েছিল, বাড়িতে ফেরার আগে আমার স্বামীর লাশ চলে আসে। তিনি বলেন, গার্মেন্ট মালিকরা আমাকে কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন। যারা আমার মতো অসহায়কে কাজের সুযোগ দিয়েছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি আমার সন্তানদের মানুষ করব। যারা এই বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য খোদেজা নাসরিন আক্তার বলেন, ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্ত। আমি হাই কোর্ট থেকে বাসায় যাওয়ার সময় বাসটি যখন শাহবাগের শিশুপার্ক এলাকায় এলো তখন বিএনপি-জামায়াতের লোকজন পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে। আমার হাত মাকড়সার জালের মতো পুড়ে যায়।
আমাকে একজন রিকশাচালক ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। আমি এখনো সেই যন্ত্রণা নিয়ে চলছি। আমাদের সবার আকুতি, জামায়াত-বিএনপির নৈরাজ্যের বিচার চাই। প্রয়োজনে আমি সাক্ষী দেব। ১৯৭৭ সালে বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা মোবারক আলী। তাকে বিচারের নামে প্রহসন করে ঝুলানো হলো ফাঁসির দড়িতে। তার কন্যা মমতাজ বেগম বলেন, আমার বয়স যখন ৬ মাস তখন আমার বাবাকে খুনি জিয়াউর রহমান ফাঁসি দেয়। কী দোষ ছিল আমার পিতার? কী দোষ ছিল আমার? কেন আমি বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হলাম? কেন বাবাকে দেখতে পেলাম না- বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মমতা। হাতে থাকা পিতার ছবি দেখিয়ে বলেন, এই যে ছবি দেখছেন, উনি আমার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোবারক আলী। আমার বাবার কবর কোথায়? জানি না, তার মৃত্যু তারিখটাও জানি না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনিও এতিম, আমিও এতিম। আমার বাবা হত্যার বিচার চাই। সবার কাছে বিচার চাই। আমি ন্যায়বিচার দেখে যেতে চাই।