আজ ৩ ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের এই দিনটিতে সূচিত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের রক্তাক্ত ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা হামলায় কোণঠাসা পাকিস্তান জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা পাওয়ার আশায় হামলা করে বসে ভারতীয় বিমানঘাঁটিগুলোতে। শুরু হয়ে যায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ। ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় মিত্রবাহিনী। যৌথবাহিনীর চতুর্মুখী আক্রমণে বিভিন্ন এলাকা ছেড়ে পালাতে থাকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী। ডিসেম্বরের শুরুতেই পাকিস্তান শুনতে পেয়েছিল পরাজয়ের ঘণ্টা। মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় একের পর এক এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতছাড়া হচ্ছিল। নাস্তানাবুদ পাকিস্তান ভেবেছিল মুক্তিযুদ্ধকে দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধ হিসেবে দেখানো গেলে জাতিসংঘের কাছ থেকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসবে। তখন তারা বাংলাদেশের মাটিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান করতে পারবে। এ কারণে পাকিস্তান বিমানবাহিনী এদিন বিকালে ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোর্ট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, উত্তরালইসহ দিল্লির কাছাকাছি আগ্রার বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তখন কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। অবিলম্বে দিল্লি ফিরে মধ্যরাত্রির কিছু পরে বেতার বক্তৃতায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘এতদিন ধরে বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধ মোকাবিলায় দেশকে তৈরি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।’ ঘোষিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ড।
ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যৌথবাহিনী তৈরি করে চারদিক থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে শুরু হয় যৌথ কমান্ডের সম্মুখযুদ্ধ। নানা ডিভিশনে বিভক্ত হয়ে হানাদার বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যবাহিনী। যৌথ কমান্ড গভীর রাতে দুর্বার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর ওপর। দেশের সব অঞ্চলেই বিজয়ের বেশে এগিয়ে যেতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনী এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একদল চৌকস বীর মুক্তিযোদ্ধা মধ্যরাত থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে গিয়ে বিভিন্ন পাকিস্তানি ঘাঁটিতে বোমা বর্ষণ শুরু করে। ঘন কুয়াশার মধ্যে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বদরুল আলম যুদ্ধবিমান নিয়ে চট্টগ্রামের জ্বালানি সংরক্ষণাগারে উপর্যুপরি বোমাবর্ষণ করে ধ্বংস করে দেন। মনোবলে চিড় ধরে পাকিস্তানের। ১৯৭১ সালের এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় বরগুনা, ঠাকুরগাঁও, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া, সিরাজগঞ্জের কাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকা। যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর জেলার আরও কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সমস্ত পাক অধিকৃত বন্দর অবরোধ করে জলপথে সরবরাহ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। আক্রমণের প্রথমেই পাকিস্তান বাহিনীর সাবমেরিন ‘গাজী’কে মিত্রবাহিনী বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি ও নি®প্রদীপ ব্যবস্থা পালনের নির্দেশ দেয়।