মঙ্গলবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
ছাত্রছাত্রীদের শিখন কার্যক্রম

শেখার ঘাটতি সব শ্রেণিতেই

♦ বাংলায় ৮০ শতাংশের ইংরেজিতে ৭৬ শতাংশের ঘাটতি ♦ অষ্টম ছাড়া অন্য শ্রেণির তথ্য নেই সরকারের কাছে ♦ শর্ট সিলেবাসে ঘাটতি আরও বেড়েছে : শিক্ষাবিদ

আকতারুজ্জামান

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে প্রায় দেড় বছর বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ছাত্রছাত্রীদের শিখন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও এসব উদ্যোগে সব শিক্ষার্থী সমানভাবে অংশ নিতে পারেনি। ফলে তৈরি হয়েছে শিখন ঘাটতি। এই ঘাটতি মেটাতে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) সম্প্রতি আয়োজন করা হয় এক কর্মশালার। কর্মশালা শেষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়, কভিড মহামারির প্রভাবে মাধ্যমিক স্তরের সব শ্রেণির সব বিষয়েই শিখন ঘাটতি রয়েছে। অথচ শুধু অষ্টম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের শিখন ঘাটতি ছাড়া অন্য কোনো তথ্য নেই সরকারের কাছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিখন ঘাটতি পূরণের উদ্যোগ না নিয়ে শর্ট সিলেবাসে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়ায় শিখন ঘাটতি আরও বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) এক গবেষণা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়, চলতি বছর যেসব শিক্ষার্থী নবম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে, গত বছর অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীন তাদের শিখন ঘাটতি পরিমাপ করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলা বিষয়ে শিখন ঘাটতি রয়েছে ৮০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর। এদের মধ্যে স্বল্পমাত্রার ঘাটতি রয়েছে ২৫ শতাংশের। মধ্যম ও উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি রয়েছে যথাক্রমে ৩১ ও ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর। অন্তত ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর বাংলা বিষয়ের শিখন ঘাটতি নিরাময়ের জন্য উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। একইভাবে ইংরেজি বিষয়ে শিখন ঘাটতি রয়েছে ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থীর। এ বিষয়ের অন্তত ৫৬ ভাগ শিক্ষার্থীর ঘাটতি নিরাময়ের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছে পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট। আর গণিত বিষয়ে শিখন ঘাটতি রয়েছে ৬৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর। গণিতে উচ্চমাত্রার শিখন ঘাটতি রয়েছে ৩৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর। এই শিক্ষার্থীরা ঘাটতি নিয়েই নবম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে। কিছুদিন পর তারা দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে। বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন মাত্রায় শিখন ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে।  প্রতিবেদন বলছে- দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) শিখন ঘাটতি রয়েছে ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীর। ঘাটতির পরিমাণ বিবেচনায় সমতল, পাহাড়,   উপকূল, চর ও হাওর অঞ্চল নিরাময় কার্যক্রমের আওতায় আনা প্রয়োজন। ঘাটতি মেটাতে অতিরিক্ত নিরাময়মূলক ক্লাস গ্রহণ, অতিরিক্ত শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষক নির্দেশনার পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন, ঘাটতি নিরসনের লক্ষ্যে ইউটিউব-কিশোর বাতায়নসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শিখন কনটেন্ট আপলোডসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে এনসিটিবির কর্মশালায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়, শিখন ঘাটতি পূরণ করতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বাংলা বিষয়ে ১৫টি, ইংরেজি বিষয়ে ১৭টি, গণিতে ১৫টি (মোট ৪৭টি) অতিরিক্ত ক্লাস পরিচালনা করতে হবে। প্রতিটি অতিরিক্ত ক্লাসের পরিধি হবে ৪০ মিনিট। এই ক্লাসের জন্য শিক্ষকদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। ছুটির দিন ছাড়া সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার নবম ও দশম শ্রেণির জন্য একটি করে অতিরিক্ত ক্লাস সংযোজন করতে হবে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকার শিক্ষার্থীরা দুর্বল তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামোর জন্য করোনাকালে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি। তাদের জন্য অধিকসংখ্যক অতিরিক্ত ক্লাসের সুপারিশ করা হয়। এসব এলাকায় খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে মত দেন কর্মশালায় উপস্থিতরা। শিখন ঘাটতি নিরসনে নিরাময়মূলক ক্লাস পরিচালনার জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের তত্ত্বাবধানে শিক্ষক নির্দেশিকা ও পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতেও বলা হয়। সপ্তাহে একটি করে নিরাময়মূলক ক্লাস সংসদ টেলিভিশনে প্রচারের পাশাপাশি কমপক্ষে তিনবার এই ক্লাস পুনঃসম্প্রচারের ব্যবস্থা করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকার চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার গতকাল প্রতিবেদককে বলেন, শিখন ঘাটতি পূরণে ব্যবস্থা নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এটি বাস্তবায়ন হবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মাধ্যমে। আগামী জানুয়ারি থেকে শিখন ঘাটতি মেটাতে কার্যক্রম শুরু হতে পারে।

বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের গবেষণায় আরও বলা হয়, শুধু অষ্টম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের শিখন ঘাটতি চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু অন্য শ্রেণি বা অন্য বিষয়গুলোর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। অথচ মাধ্যমিক স্তরের সব শ্রেণির সব বিষয়েই শিখন ঘাটতি রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান প্রতিবেদককে বলেন, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যে শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে তা পূরণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অটো প্রমোশন, শর্ট সিলেবাস, কম নম্বরে পরীক্ষা শিখন ঘাটতি আরও বৃদ্ধি করেছে। নির্ধারিত সিলেবাস একেবারে অসম্পন্ন রেখে ছাত্রছাত্রীদের পাস করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে এই শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা স্তরে গিয়ে যেমন হোঁচট খাচ্ছে ও খাবে, তেমনি কম শিখে পাস করা গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে জাতিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে চরমভাবে।

সর্বশেষ খবর