শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

গতানুগতিক নাকি নতুনত্ব

আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন আজ

রফিকুল ইসলাম রনি

গতানুগতিক নাকি নতুনত্ব

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন। বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এবারের সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারবিরোধী আন্দোলন রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করে দলকে টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় আনার জন্য কেমন চমক থাকবে এবারের সম্মেলনে? গতানুগতিক নাকি নতুনত্ব থাকবে- সেদিকে দৃষ্টি দলীয় নেতা-কর্মীসহ দেশবাসীর। সারা দেশে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে মিলনমেলায় পরিণত হবে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অর্থ সাশ্রয়ের জন্য এবার এক দিন হবে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সকাল সাড়ে ১০টায় এ সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধনের পর ২৫ মিনিটের একটি উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করা হবে। সেখানে তুলে ধরা হবে আওয়ামী লীগের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সরকারের উন্নয়ন ও সাফল্য।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেবেন। শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করবেন দলের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন ওবায়দুল কাদের। স্বাগত বক্তব্য দেবেন অভ্যর্থনা কমিটির আহ্বায়ক শেখ ফজলুল করিম সেলিম। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন শেষ হবে।

বিকাল ৩টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শুরু হবে কাউন্সিল অধিবেশন। এ অধিবেশনে দলের  সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হবে। টানা দশমবারের মতো সভানেত্রী নির্বাচিত হবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সাধারণ সম্পাদকসহ বড় পদগুলোয় কোনো পরিবর্তনের আভাস আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাছ থেকে মেলেনি। টানা দুই মেয়াদে দায়িত্বে থাকা ওবায়দুল কাদের হ্যাটট্রিক করে নতুন চমক সৃষ্টি করবেন নাকি অন্য কেউ আসছেন- তা গত রাত পর্যন্তও ছিল আলোচনার শীর্ষে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রানিংমেট হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের থেকে যাওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নতুন কেউ আসতে পারেন- এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সবকিছু নির্ভর করছে জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার ওপর। কারণ কাউন্সিলররা সাধারণ সম্পাদকসহ নেতা নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব তাঁর ওপর ছেড়ে দেন। কাউন্সিল অধিবেশনে দলীয় সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও প্রেসিডিয়াম, সম্পাদকীয়, কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য, স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যের অধিকাংশ নামই ঘোষণা করা হতে পারে আজ। আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় তুলে ধরা হবে। এ বিষয় সামনে রেখেই সম্মেলনের স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে ‘উন্নয়ন অভিযাত্রায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়’।

দেশের বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর। সেই সম্মেলনে টানা নবমবারের মতো সভানেত্রী পদে শেখ হাসিনা ও দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ওবায়দুল কাদের। দলের গঠনতন্ত্রে তিন বছর পরপর সম্মেলন করার কথা রয়েছে। একমাত্র আওয়ামী লীগই বিগত কয়েকটি সম্মেলন সঠিক সময়ে করে আসছে।

সম্মেলন উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পদ্মা সেতুর ওপর নৌকার আদলে তৈরি ৮০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৪৪ ফুট প্রস্থের মঞ্চ তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। মূল মঞ্চের উচ্চতা হবে ৭ ফুট। সাংস্কৃতিক পর্বের জন্য তৈরি হচ্ছে আলাদা মঞ্চ। মূল মঞ্চে চার ভাগে চেয়ার সাজানো হবে। প্রথমে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বসবেন। পরে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, জ্যেষ্ঠ নেতা ও প্রেসিডিয়াম সদস্যরা বসবেন। বাকি দুই ভাগে বসবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। মোট ১২০টি চেয়ার রাখা হবে। এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১২টি এলইডি মনিটর স্ক্রিন রাখা হয়েছে। যেখানে সম্মেলনের কার্যক্রম দেখা যাবে।

মঞ্চের পেছনে বসানো হয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রতিকৃতি। এক পাশে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, মেট্রোরেলসহ উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলোর চিত্রের পাশাপাশি জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছবি স্থান পেয়েছে। আরেক পাশে শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর কর্মতৎপরতার ছবির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের চার প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হক ও মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের ছবি স্থান পেয়েছে। মঞ্চের সামনের অংশে পদ্মা সেতুর আদলে রেলিং তৈরি করা হয়েছে। মঞ্চের পুব দিকে একটি নৌকায় ব্যবস্থা করা হয়েছে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের স্থান। এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিভিন্ন স্থানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ছবি দিয়ে ফেস্টুন করা হয়েছে। এদিকে সম্মেলন উপলক্ষে অধিকাংশ কাউন্সিলর ও ডেলিগেট গতকালই ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন। এবার কাউন্সিলর ৭ হাজার ৩৩৭ জন। সমসংখ্যক রয়েছেন ডেলিগেটও। সব মিলে ৫০ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীর খাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন উপলক্ষে ১১টি উপকমিটি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছে। প্রথা অনুযায়ী সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও সদস্যসচিব সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দাওয়াতপত্র বিতরণ, গঠনতন্ত্র সংযোজন-বিয়োজন, ঘোষণাপত্র পরিমার্জন, মঞ্চ সাজসজ্জাসহ আনুষঙ্গিক সব কাজ শেষ হয়েছে।

নিবন্ধিত সব দলকে আমন্ত্রণ : স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দলকে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বাসদ, ন্যাপসহ অন্যান্য দলের নেতাদের কাছে আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন গঠন : আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় কাউন্সিল উপলক্ষে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। ১৭ ডিসেম্বর রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির বৈঠকে নির্বাচন কমিশন গঠন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন দলের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন। অন্য দুই সদস্য হলেন ড. মশিউর রহমান ও সাহাবুদ্দিন চুপ্পু।

যেখানে নির্বাচিত হবেন নতুন নেতৃত্ব : বিকাল ৩টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশেই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শুরু হবে কাউন্সিল অধিবেশন। এতে নির্বাচন করা হবে আগামী তিন বছরের জন্য নতুন নেতৃত্ব। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হবে। এতে অনুমোদন করা হবে দলের গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র। দলের কোষাধ্যক্ষ এ এইচ এন আশিকুর রহমান অর্থ বিল উত্থাপন করবেন এবং কাউন্সিলরদের ভোটে তা পাস হবে। ঘোষণাপত্র উপকমিটির আহ্বায়ক শেখ ফজলুল করিম সেলিম দলের ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন এবং কাউন্সিলরদের ভোটে তা পাস হবে। এরপর দলের গণতন্ত্র সংশোধন উপকমিটির আহ্বায়ক ড. আবদুর রাজ্জাক দলের গঠনতন্ত্রের সংযোজন, বিয়োজনের বিষয়গুলো তুলে ধরবেন এবং কাউন্সিলরদের ভোটে তা পাস হবে। এরপর দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা সমাপনী ভাষণ এবং জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় নেতা-কর্মীদের করণীয় কী সেই বার্তা দিয়ে কার্যনির্বাহী সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের নেতারা সাধারণ কাউন্সিলরের কাতারে বসবেন। তারপর সম্মেলনের নির্বাচন কমিশন কাউন্সিল অধিবেশন পরিচালনা করবে। প্রথা অনুযায়ী একজন সভানেত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করবেন। আরেকজন সমর্থন করবেন। এ পদে অন্য কেউ প্রার্থী না থাকায় নির্বাচন কমিশন টানা দশমবারের মতো শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী নির্বাচিত ঘোষণা করবেন। এরপর কাউন্সিলররা সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য দলের সভানেত্রীর ওপর দায়িত্ব দেবেন। সভানেত্রীর সুপারিশে একজন প্রস্তাব দেবেন আরেকজন সমর্থন করবেন। যার নাম প্রস্তাব ও সমর্থন করা হবে সেই পদে অন্য কোনো প্রার্থী না থাকলে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। এরপর প্রেসিডিয়াম, সম্পাদকীয়, কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য, স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যের অধিকাংশ নামই ঘোষণা করা হতে পারে আজ। আজ সকাল ৭টায় সম্মেলনস্থলে প্রবেশের গেট খুলে দেওয়া হবে। সম্মেলনে প্রবেশের জন্য পাঁচটি গেট থাকবে। তার মধ্যে একটি ভিআইপি ও চারটি থাকবে ডেলিগেট ও কাউন্সিলরদের প্রবেশের জন্য। কাউন্সিলরের সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। তার দ্বিগুণ অফিশিয়াল ডেলিগেট থাকলেও এর সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ব্যাপক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সম্মেলনে আসা নেতাদের সেবা দিতে প্রস্তুত রয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যরা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর