মেট্রোরেল লাইন-৬ চালুর মাধ্যমে যোগাযোগের নতুন এক দুয়ার উন্মোচিত হলো ঢাকাবাসীর জন্য। বহুল প্রতীক্ষিত এই মেট্রোরেল নগরবাসীকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে। জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গতকাল এর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে মেট্রোরেলের যাত্রী হিসেবে নিজেই টিকিট কেটে ছোট বোন শেখ রেহানা ও আরেক বর্ষীয়ান নারী রাজনীতিবিদ মতিয়া চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ভ্রমণ করেন শেখ হাসিনা। এ প্রকল্প চালু হওয়া ঢাকার পরিবহন জগতের জন্য একটি অনন্য মাইলফলক বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
স্বাধীন বাংলাদেশ হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এক সচ্ছল সোনার বাংলা- মুক্তিযুদ্ধের আগে বাঙালি জাতিকে এমন স্বপ্নই দেখিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন করলেও তাঁর সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে দেয়নি হায়েনার দল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের শুরুতেই তাঁকে সপরিবারে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেওয়া হয় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর দেখা সেই স্বপ্ন ও জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর তাঁর বড় মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে কথাই তিনি গতকালের ভাষণে উপস্থিত সুধীমন্ডলীকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। চলতি বছরেরই ২৫ জুন পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ এক অবকাঠামো চালুর পর যোগাযোগ খাতের আরেক মেগা প্রকল্প মেট্রোরেল লাইন-৬-এর একাংশ চালু হলো গতকাল। এ যেন বাঙালি জাতির এক পরম পাওয়া। এজন্যই হয়তো পুলিশের দেওয়া কড়া নির্দেশনা উপেক্ষা করে জনতার উচ্ছ্বাস দেখতে হয়েছে দিয়াবাড়ী, উত্তরা, মিরপুর, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁওসহ সমস্ত ঢাকাবাসীকে। একই সঙ্গে টেলিভিশনের পর্দায় সেই উচ্ছ্বাস দেখেছে গোটা দেশবাসী।
সুধীসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বাধীনতার পর কোনো সরকারই দেশ গঠনে এতটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেনি, যেটা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার করেছে। এজন্য ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর দেশকে স্বনির্ভর করে তুলতে এক অভূতপূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এতে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার পূর্বশর্ত হিসেবে যোগাযোগ, প্রযুক্তি, কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন শেখ হাসিনা। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২০১৬ সালের ২৬ জুন মেট্রোরেল লাইন-৬ প্রকল্পের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যাই। ঠিক সাড়ে ছয় বছর পর তিনিই দেশের প্রথম এ বৈদ্যুতিক রেলের প্রথম যাত্রী হয়েছেন গতকাল, যার মাধ্যমে মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। যদিও এটা উড়ালপথের মেট্রো। শুধু তা-ই নয়, এর মধ্য দিয়ে নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করল বাঙালি জাতি। জানা যায়, এর আগে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ। জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে সমীক্ষা পরিচালনার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন ডিটিসিবি। ২০০৯ সালের মার্চ থেকে ২০১০ সালের মার্চ পর্যন্ত এক বছরের ওই সমীক্ষায় সবার আগে ‘এমআরটি লাইন-৬’ নির্মাণের সুপারিশ আসে। পরের বছরই ওই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করে জাইকা। যার চূড়ান্ত ফলস্বরূপ গতকাল উদ্বোধন করা হলো এ লাইনের। আজ শুরু হচ্ছে যাত্রী চলাচল।২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু খোলার পর বুধবার খুলেছে দ্বিতীয় স্বপ্নের দ্বার। পদ্মা সেতুর পর এবার বাঙালি জাতির আরও একটি অবিশ্বাস্য স্বপ্ন পূরণ হলো। যানজটের নগরী ঢাকায় বহুল কাক্সিক্ষত স্বপ্নের মেট্রোরেলের যাত্রী হিসেবে সাধারণ মানুষ চলাচল করবে আজ থেকেই। এর মধ্য দিয়ে যাতায়াতের কষ্ট অনেকটাই লাঘব হবে ৪০০ বছরের পুরনো এই নগরবাসীর। বিশেষ করে উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটের যাত্রীরা খুবই স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবেন মেট্রোপথে। ওদিকে আগামী বছরের শুরুতেই আরেকটি নতুন দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে বন্দরনগর চট্টগ্রামে। শহরের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিতব্য কর্ণফুলী টানেলের কাজও প্রায় শেষ দিকে, যার মাধ্যমে টানেলপথের যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। এ কথা অবশ্য গতকাল সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুর মতো অবকাঠামো গড়ে তোলা আমাদের জন্য খুবই গর্বের, যা এই প্রথম আমরা করেছি। এখন চালু হলো মেট্রোরেল। এটিও প্রথম। এরপর চালু হতে যাচ্ছে কর্ণফুলী টানেল। সেটিও হবে প্রথম।’
ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক জানিয়েছেন, শুরুতে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলবে মেট্রোরেল। পৌনে ১২ কিলোমিটারের এ পথ মেট্রোরেলে পাড়ি দিতে লাগবে ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ড। অবশ্য গতকাল প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ট্রেনের সময় লেগেছে ১৭ মিনিট। আপাতত উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলার সময় ট্রেনগুলো মাঝপথে কোথাও থামবে না। ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের এই পথে ৯টি স্টেশন থাকলেও উত্তরা ও আগারগাঁওয়ের যাত্রী ছাড়া অন্যরা এ সুবিধা পাবেন না। তবে ২৬ মার্চের পর সব স্টেশনেই ওঠানামা করতে পারবেন যাত্রীরা। ইতিহাস ও উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন মেট্রোরেল ব্রিটিশদের লন্ডন মেট্রো, যা নির্মাণ করা হয় ১৮৬৩ সালে। এরপর প্যারিস মেট্রো চালু হয় ১৯০০ সালে। এরপর ধীরে ধীরে নিউইয়র্ক শহরে হার্ডসন নদীর তলদেশ দিয়ে মেট্রো বা সাবওয়ে নির্মাণ করা হয় ১৯০৪ সালে। রাশিয়ার মস্কোয় চালু হয় ১৯৩১ সালে। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনবহুল শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মেট্রোরেল। তবে অধিকাংশ দেশের মেট্রোই মাটির নিচে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের মেট্রোরেলের বয়সও ৪০ বছরের বেশি। সেটিও মাটির নিচে। এজন্যই বলা হয়, লন্ডন, প্যারিস ও নিউইয়র্ক শহরের রাস্তার ওপরের চেয়ে মাটির নিচের জগৎটা বেশি ব্যস্ত। সেসব শহরে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ নির্বিঘ্নে ছুটে চলেন। এসব দেশের অর্থনীতি অনেক আগে থেকেই বেশ সমৃদ্ধ এবং মজবুত ভিতের ওপর গঠিত। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর বাঙালি জাতি এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সাহস দেখিয়েছে সেটিও কম নয়। খোদ জাপানিরাও বলছেন এটি বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য বিরাট এক সফলতা। জাপানে মেট্রোরেল চালু হয়েছে ১৯৪১ সালে। আর বর্তমানে বিশ্বকে প্রযুক্তিতে নেতৃত্ব দানকারী দেশ চীনে মেট্রোরেল চালু হয় ১৯৬৯ সালে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া জার্মানিতেও এর ৩০ বছর পর মেট্রোরেল নির্মিত হয়। এর অন্যতম কারণ হলো সেসব দেশের অর্থনীতির ভিত অনেক মজবুত।
এদিকে গতকাল বেলা ১১টায় উত্তরায় মেট্রোরেলের নামফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তিনি সেখানে সুধীসমাবেশে বক্তব্য দেন। আনুষ্ঠানিকতার শেষের দিকে সবুজ পতাকা উড়িয়ে প্রথমবারের মতো ট্রেন চালু করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে করে তিনি নিজে টিকিট কেটে ট্রেনের যাত্রী হয়ে আগারগাঁও পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ডাক বিভাগ থেকে ইস্যু করা মেট্রোরেলের স্মারক ডাকটিকিট ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইস্যু করা ৫০ টাকার স্মারক নোট অবমুক্ত করা হয়। অনুষ্ঠানস্থলে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় আগে থেকেই সাত দফা নির্দেশনা জারি করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। কিন্তু সেই কড়া নির্দেশনা উপেক্ষা করে উৎসুক জনতার উচ্ছ্বাসে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে পুরো দিয়াবাড়ী, উত্তরা, মিরপুর, আগারগাঁও অঞ্চল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সুধীসমাবেশে অংশ নিতে আসা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ যোগ দেন আনন্দ উৎসবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হন মন্ত্রী, সচিব, কূটনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা, ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তা, নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, জাপান সরকারের প্রতিনিধি, রাষ্ট্রদূতসহ নানা শ্রেণির মানুষসহ ২০০ জন।
এ ছাড়া মেট্রোরেলের উদ্বোধন করায় সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাস। একই সঙ্গে প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম বলেছে, মেট্রোরেল আওয়ামী লীগ সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। সংবাদমাধ্যমটি আরও বলেছে, এর মধ্য দিয়ে যাতায়াতের কষ্ট অনেকটাই লাঘব হবে ঢাকাবাসীর। আর এর জেরে উজ্জ্বল হবে আওয়ামী লীগ সরকারের ভাবমূর্তি। মেট্রোরেল প্রকল্পটি ঢাকায় মানুষের যাতায়াতের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে। পাশাপাশি এর উদ্বোধন শেখ হাসিনার সরকারকে অতি প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সুবিধাও দেবে বলে মনে করে ব্লুমবার্গ।