মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভোটের আগে জোটের হাওয়া

রফিকুল ইসলাম রনি

ভোটের আগে জোটের হাওয়া

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এখনো এক বছর। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা সমীকরণ। এর অংশ হিসেবে পুরনো জোট ভাঙছে, গড়া হচ্ছে নতুন জোট। কিছুদিন হলো প্রতিদিনই নতুন নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটছে। নিবন্ধনহীন, নাম-প্যাডসর্বস্ব দলগুলো জোট গঠনের তোড়জোড় শুরু করেছে। লক্ষ্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সুবিধামতো আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়া। ‘বহু দলের সমর্থন’ আছে- এ তকমা কাজে লাগিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দরকষাকষি করতে চায় তারা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘ভোটের আগে জোটের হাওয়া’ লেগেছে রাজনীতিতে। তাই নিত্যনতুন জোটের আত্মপ্রকাশ হচ্ছে। নীতি-আদর্শের বালাই নেই এ ভাঙাগড়ায়। সবার লক্ষ্য ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া। সংসদে প্রবেশের রাস্তা প্রশস্ত করা।

বিগত ছয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জোটের রাজনীতিই ভোটের ফলাফল নির্ধারণ করেছে। এ সময়ে জাতীয় পার্টি ও জামায়াত প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। একই সঙ্গে সংসদে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করেছিল দল দুটি।

জানা গেছে, সারা বছর গুরুত্ব না থাকলেও নির্বাচনের আগে নামসর্বস্ব ছোট দলগুলোকেও কাছে টানে বড় দলগুলো। আদর্শিক মিল না থাকলেও ছোট দলগুলো বড় দলের জোটে ভেড়ার চেষ্টা করে। বড় দলগুলোও তাদের কাছে টানার চেষ্টা করে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় এক বছর বাকি থাকলেও ভোটের মাঠে অস্তিত্ব নেই, এমন দল মিলে নতুন জোট গড়ছে। শুধু রাজনৈতিক দলই নয়, পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন জোটের রাজনীতিতে নাম লেখাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সূত্র জানান, টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ মিত্র বাড়াতে চাইছে। যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় ক্ষমতাসীনরা। ছোট দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই থাকুক, রাজনৈতিক গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই এসব দলকে বড় দুই দল জোটে টানছে। বাম ঘরানা ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর ১৪-দলীয় জোটের শরিক কাউকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি। এ নিয়ে ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের ক্ষোভ রয়েছে। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শরিকদের ক্ষোভ প্রশমনে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনের দুটিতে শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদকে ছাড় দিয়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী দেয়নি।

ইতোমধ্যে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমকে ডেকে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত রবিবার জেপির সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর দিল্লিতে যখন প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) আমাকে দেখেন, উনি আমাকে ভাই বলে ডেকেছিলেন। সেদিন যে গিয়েছিলাম, কথা হলো। সেখানেও বলেছেন, তোমাকে ভাই বলে ডেকেছি। আমি আজীবন ভাইয়ের মর্যাদা রক্ষা করব।’ তিনি বলেন, ‘আমি ও রকম কাঁচা না। আমাকে যিনি ভাই বলে ডেকে তাঁর মর্যাদা রক্ষা করতে পারেন, আমিও তাঁর (বোন) মর্যাদা রক্ষা করতে পারি, তাঁর জন্য জীবন দিতে পারি।’ একই সঙ্গে ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টে যাওয়া সবচেয়ে ভুল হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন কাদের সিদ্দিকী। বঙ্গবীরের এমন বক্তব্যের পর ধরে নেওয়া হচ্ছে, আগামীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে ভিড়তে পারেন তিনি।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ছোট ছোট জোটেরও জন্ম হচ্ছে। সবারই লক্ষ্য সংসদ নির্বাচন। এসব জোটের কেউ প্রধান দুই দলের পৃষ্ঠপোষকতা চায়, আবার কোনো কোনো জোট বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের জানান দিতে চায়। নিজেদের কদর বাড়াতে চলছে দেনদরবারও।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে এককভাবে জেতার ক্ষমতা রয়েছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। তার পরও ছোট দলগুলোকে কাছে টানার কারণ, প্রতিপক্ষকে দেখানো যে তার সঙ্গে অনেক দল রয়েছে। পরগাছার মতো ছোট দলগুলো নীতি-আদর্শের মিল না থাকলেও জোটে যাচ্ছে সুবিধা পাওয়ার আশায়। ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার লোভে। এমপি-মন্ত্রী হতে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এক দলের এক নেতাকেও মন্ত্রিসভায় দেখা গেছে।

রবিবার রাজধানীতে জাতীয় পার্টি-জেপির সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সব ভেদাভেদ ভুলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে এক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।

বিএনপি সূত্র জানান, সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের গতি ও ব্যাপ্তি বাড়াতে ২০-দলীয় জোট অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দিয়েছে বিএনপি। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের দিন এক অনানুষ্ঠানিক সভায় শরিকদের ডেকে বলে দেওয়া হয়, এখন থেকে কেউ যেন ২০-দলীয় জোটের নাম ব্যবহার না করে। এর উদ্দেশ্য, দলগুলো যাতে যার যার অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হয়। দেশবাসীসহ বিশ্ববাসীর কাছে যাতে তুলে ধরতে পারে, তারা জোট নয়, এসব রাজনৈতিক দল সরকারের পতন চায়।

সর্বশেষ রবিবার সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন এগিয়ে নিতে ১৫টি সংগঠনের সমন্বয়ে ‘সমমনা গণতান্ত্রিক জোট’ নামে আরেকটি নির্বাচনী জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এ জোটের ঘোষণা দেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। এ জোটে থাকা একটি রাজনৈতিক দলেরও ইসির নিবন্ধন নেই। এর আগে ‘১২-দলীয় জোট’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ জোটের নেতৃত্বে আছেন সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার।

এর বাইরে ন্যাশন্যাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে ১২ দলের সমন্বয়ে গঠিত জোট বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করবে। বাম গণতান্ত্রিক জোট ভেঙে আরও বেশ কয়েকটি দলের সমন্বয়ে এ জোটের পথচলা শুরু হয়েছে। এ জোটের অন্যতম নেতা নুরুল হক নূর, মাহমুদুর রহমান মান্না, জোনায়েদ সাকি, সাইফুল হকসহ অনেকেই। চার রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য ইতোমধ্যে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে রয়েছে। বাম গণতান্ত্রিক জোটে সিপিবিসহ এখন চারটি দল রয়েছে। এ জোট বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে আছে। ১১ রাজনৈতিক দল মিলিয়ে ‘নাগরিক মঞ্চ’ হাঁটছে বিএনপির দেখানো পথেই।

চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ১০ ইসলামী দল স্বতন্ত্র জোট গঠন করেছে। ২০-দলীয় জোটের সাবেক নেতা শওকত হোসেন নীলুর ভাই সালুর নেতৃত্বে ১৭ দলের আরেকটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক জোট এখনো কোনো দলকে সমর্থন দেয়নি।

জানা গেছে, বিএনপি ছোট দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু করায় টনক নড়ে আওয়ামী লীগের। দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রমসহ অন্যরা ছোট দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে।

সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে মহাজোটগতভাবে নির্বাচন করবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের ভাবনায় সিপিবি, বিকল্পধারা বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হতে পারে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, ‘জোট সম্প্রসারণের পরিকল্পনা আছে। যারা দেশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা মানে এমন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের ঐক্য হতে পারে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর