শিরোনাম
সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চেতনার বাতিঘর

ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চেতনার বাতিঘর

১৯৫২ সালের মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং চেতনা জাগ্রত করার এক অনন্য সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের প্রেরণায় পরবর্তীতে বাঙালির প্রতিটি প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ এবং যুগপৎ মাত্রা লাভ করে। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রই ভাষা আন্দোলনের কারণে নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়। নতুন প্রজন্মকে ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বীবিত করে দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তাদের মধ্যে সঞ্চার করতে হবে। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র ভাগ হওয়ার পরপরই পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি জনসাধারণ উপলব্ধি করতে থাকে তাদের অবহেলিত অবস্থান। ভাষা নিয়ে বিতর্কটা তখন থেকেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনই পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি জনসাধারণের উপলব্ধি আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। তিনি বাঙালির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও প্রথাকে স¦মহিমায় টিকিয়ে রাখার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। যে কারণে ১৯৪৭-পরবর্তী সময় পূর্ব-পাকিস্তানের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি প্রচলন ও প্রতিষ্ঠায় জনমত গঠন করতে সভা-সমাবেশসহ নানা কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু, পরবর্তী সময় যা পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের মধ্যে জাগরণ তৈরি করে। বলা যায়, ’৪৭ থেকেই ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আর এ আন্দোলনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

১৯৫২ সালে রফিক, শফিক, সালাম, বরকতের রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষা পূর্ব-পাকিস্তানের আপামর বাঙালির ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্য দিয়ে যে চেতনা জাগ্রত হয় তা হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা, বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার চেতনা, যা মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মোপলব্ধিতে উল্লিখিত বিষয়গুলো অত্যন্ত জোরালো প্রভাব ফেলেছিল বলেই তিনি ১৯৬৬ সালে ‘বাংলার মুক্তিসনদ’ হিসেবে খ্যাত এবং আমার বিশ্লেষণে ‘বঙ্গবন্ধুর ব্রেইন চাইল্ড’ ঐতিহাসিক ছয় দফা দিয়েছিলেন। ১৯৫২ থেকে বর্তমান সময় ২০২৩-এ এসে দাঁড়িয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিহাস এবং এযাবৎকালের সব প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চেতনার বাতিঘর হিসেবে প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু বর্তমান তরুণ প্রজন্ম একদিকে যেমন ভাষা আন্দোলন দেখেনি, অন্যদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধও দেখেনি। ফলে তাদের চেতনায় ইতিহাসনির্ভর তথ্যের প্রভাব গুরুত্বসহ প্রতিফলিত হচ্ছে না। অথচ, তরুণ প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য সঞ্চালন অত্যন্ত গুরুত্ববহ। কেননা, বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মন ও মননে ত্যাগের মহিমা জাগ্রত করতে হলে অবশ্যই ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে হবে। ভাষার জন্য রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকতের মতো তরুণদের জীবনদান, বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্ব, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ, সম্ভ্রম হারানো লাখ লাখ মা-বোনের ত্যাগের মহিমা নতুন প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তরুণ প্রজন্মকে দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়তে হলে আমাদের সব ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন সংগ্রামের সঠিক ও যথাযথ তথ্য উপস্থাপন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, যা তরুণ প্রজন্মকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হবে। ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগত প্রেরণা তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালির আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং নিজের সিদ্ধান্ত নিজের নেওয়ার সক্ষমতা প্রতিষ্ঠায়। নতুন প্রজন্মকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার আবর্তে চেতনা ও প্রেরণায় সংযুক্ত করে দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে অবদান রাখতে উদ্বুদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, যা বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার পাথেয় হবে। 

লেখক : উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

 

সর্বশেষ খবর