মঙ্গলবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভাষার জন্য ভালোবাসা

ইমদাদুল হক মিলন

ভাষার জন্য ভালোবাসা

১. এখন আর আগের মতো সারা বছর আমাদের বইগুলো প্রকাশিত হয় না। সব বই-ই একটা সময়ে এসে প্রকাশিত হয়, আমাদের ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে। বইমেলায় হাজার হাজার বই প্রকাশিত হতে দেখছি কয়েক বছর ধরে। সেসব বইয়ের মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দেয়, তা দেবেই। প্রকাশিত ৪-৫ হাজার বইয়ের মধ্য থেকে যদি ৫০, ১০০ বা ২০০ মানসম্পন্ন বই প্রকাশিত হয়, তাতেই আমি সন্তুষ্ট।

ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসাটা উপলব্ধি করা যায় বইমেলায় গেলে। লেখক-পাঠক-প্রকাশকের এ মিলনমেলায় রক্ত দিয়ে পাওয়া আমাদের বাংলা ভাষা যেন ঝলমলিয়ে ওঠে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও ভাষাশহীদদের স্মৃতির প্রতি আমাদের ভালোবাসা তীব্রভাবে জেগে ওঠে এ মাসে। বাংলা এখন পৃথিবীর সপ্তম বড় ভাষা। ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সব মিলিয়ে বাংলা ভাষার বিজয় বাংলাদেশেরই বিজয়। ভাষা আন্দোলন থেকেই শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার আন্দোলন। ১৯৭১-এ সেই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। এবারের বইমেলা উপলক্ষে আমি একটি মাত্র বই লিখেছি। এখন সেই বইটির কথা একটু বলি।

২. এ বছর আমার লেখক জীবনের ৫০ বছর পূর্ণ হলো। ১৯৭৩ সালের এক মনোরম বিকালে গল্প লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেই আশ্চর্য বিকালটি এখনো আমাকে তাড়া করে। গেন্ডারিয়ার দীননাথ সেন রোডে ‘সীমান্ত গ্রন্থাগার’। আমার বিকাল-সন্ধ্যাগুলো কাটত সেই গ্রন্থাগারে। যে বিকালে লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেটি ছিল ফাগুন দিনের স্নিগ্ধ মায়াবী বিকাল। গোধূলিবেলা সমাগত। প্রেমিকার হাসির মতো আলোয় আলোয় ভরে আছে চারদিক। সীমান্ত গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়ে আমি উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে শুরু করেছিলাম। গেন্ডারিয়ায় তখন কত মাঠ-পুকুর, কত গাছপালা আর ফুলের গন্ধ। কত পাখি আর প্রজাপতির ওড়াউড়ি। আমার বয়স তখন সতেরো। চোখজুড়ে কত স্বপ্ন। এই হব, সেই হব। এই দুঃখময় জীবন বদলে ফেলব একদিন। সেই বদল ঘটল লেখক হিসেবে। প্রথম লেখাটি ছাপা হওয়ার পরই লেখক জীবনের পথে আমি দৌড়াতে শুরু করি, ছুটতে শুরু করি। তার ফাঁকে ফাঁকে জীবন বদলের আশায় কত কাজ। জগন্নাথ কলেজে পড়া। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে অজস্র টিউশনি। বড় ভাইয়ের কন্ট্রাক্টরি দেখভাল করা। রোজগারের আশায় জার্মানিতে পাড়ি দেওয়া। ফিরে এসে একের পর এক ব্যর্থতা চারদিকে। বন্ধুদের অবহেলা, অপমান। রোজগার করতে পারি না বলে পরিবারে অশান্তি। এত কিছুর মধ্যেও একটা মায়ার জায়গা রয়ে গেল। লেখালেখি। সেই জগৎ থেকে আমি আর বেরোতে পারলাম না। লেখক জীবনের পথে আমি হাঁটতেই থাকলাম, হাঁটতেই থাকলাম। তারপর কত লেখা, কত বই। কত সুনাম, কত দুর্নাম। কত আদর-আপ্যায়ন-সম্মাননা। তার পরও আমার স্বপ্ন ফুরায় না। তার পরও আমি একটি ভালো লেখার আশায় সব প্রলোভন তুচ্ছ করে চলতে থাকি। ৫০ বছরের সেই চলা আমার শেষ হয়নি। এই জীবনের কথাই অনুপুঙ্খভাবে, বিশদভাবে লিখবার চেষ্টা করেছি ‘যে জীবন আমার ছিল’ বইটিতে। কত মানুষ ছায়া দিয়েছে, ভালোবেসে হাত ধরেছে কত মানুষ। আবার অবহেলা, অপমানও করেছে কতজন। দুঃখ-বেদনার কথা আমি মনে রাখতে চাইনি। মনে রেখেছি আমার পাশে যারা ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের কথা। যারা ভালোবেসেছিল তাদের কথা। মানুষের জীবন কতরকম দুঃখ-আনন্দে মাখামাখি হয়ে থাকে। জীবনপথের পায়ে পায়ে কত স্মৃতি, কত মায়া, কত অনাদর। সবকিছুই মানুষের জীবন সমৃদ্ধ করে। আমি সেই সমৃদ্ধ জীবনের সন্ধান করেছি ‘যে জীবন আমার ছিল’ বইটিতে। হয়তো এ বই আমার আত্মজীবনী, হয়তো এ বই স্মৃতিকথা। আমার জন্মের গ্রাম বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল থেকে জীবনযাত্রাটা শুরু হয়েছিল। তারপর জীবনের পথে আমি হাঁটছি তো, হাঁটছিই। আমার হাঁটার সঙ্গে হাঁটে আমার স্বপ্নগুলো, আমার স্মৃতিগুলো। স্বপ্ন আর স্মৃতি নিয়ে ‘যে জীবন আমার ছিল’।

৩. ভাষার প্রতি ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে যে কথাটা আমার সব চাইতে জরুরি মনে হয় তা হলো, রক্ত দিয়ে পাওয়া এ ভাষার মূল্যায়ন কি আমরা যথাযথভাবে করতে পারছি? বাংলা ভাষার প্রতি সত্যিকার অর্থে কি সেই ভালোবাসাটা আমাদের আছে? নাকি নিজের ভাষাকে আমরা অনেকখানি অবহেলাও করছি? বাংলা ভাষার ভালো সাহিত্যগুলো কেন অনুবাদের মাধ্যমে অন্য ভাষার পাঠকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না? কেন আমরা এ ব্যাপারটায় এতখানি পিছিয়ে আছি? ফেব্রুয়ারি এলেই ভাষার প্রতি ভালোবাসা আমাদের তীব্র হয়ে ওঠে ঠিকই, কিন্তু ব্যাপারটা কি এই এক মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বছর ধরেই আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রসারের চেষ্টা করব আর আমাদের উচ্চমানের সাহিত্যকর্মগুলো অনুবাদের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর অন্য ভাষার পাঠকের হাতে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব? বিষয়গুলো নিয়ে ভাববার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মনোযোগ আমি আকর্ষণ করছি।

বাংলা ভাষার জয় হোক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর