শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

মরে যাচ্ছে ভরা নদী

নদীর বুকে ফসল ও মাছ চাষ, চলাচলের রাস্তা

শামীম আহমেদ

মরে যাচ্ছে ভরা নদী

তিন দশক আগেও স্রোতস্বিনী পদ্মার গর্জনে দক্ষ মাঝি-মাল্লারাও অনেক সময় সাহস পাননি পদ্মার বুকে খেয়া ভাসাতে। জেলেরা নদীতে গেলে উদ্বেগে থাকত পরিবার। সেই পদ্মার অধিকাংশ স্থান এখন শুকিয়ে শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। নদীর বুকে জেগে উঠেছে বড় বড় চর। সেই চরে চাষ হচ্ছে ধান ও বিভিন্ন সবজি। ঘরবাড়ি তুলে বসবাস করছে অনেক পরিবার। একইভাবে মরতে বসেছে মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ভৈরব, কুমার, নবগঙ্গা, চিত্রা, মধুমতি, ঘাঘট, মহানন্দাসহ দেশের অধিকাংশ নদ-নদী। শুষ্ক মৌসুমে বগুড়ার সারিয়াকান্দি এলাকায় হেঁটে যমুনা নদী পার হয়ে যাচ্ছে মানুষ। নাব্য হারিয়ে মরে যাচ্ছে একের পর এক নদী। এরই মধ্যে অনেক নদী দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) দেশের অনেক স্থানে রেকর্ড দেখে নদী চিহ্নিত করে সাইন বোর্ড বসিয়েছে, বর্তমানে যেখানে নেই নদীর কোনো চিহ্ন।

নদী গবেষকদের হিসাবে দেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সহস্রাধিক নদী থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) হিসাবে বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে আছে ৪০৫টি নদ-নদী। এ ছাড়া ৫৭টি আছে আন্তঃদেশীয় নদী সংযোগ। অর্থাৎ, হিসাবের খাতা থেকেই হারিয়ে গেছে অনেক নদী। আবার হিসাবে থাকা নদ-নদীর মধ্যে অনেক নদী দখল ও ভরাট হয়ে বিলুপ্তির পথে।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্স সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা জরিপ করে দেখেছি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে ১ হাজার ২৭৪টি নদী ছিল। গত বছর নদীগুলোর নামসহ তালিকা প্রকাশ করেছি। নদীরক্ষা কমিশন ৭২০টি নদীর হিসাব পেয়েছে। অর্থাৎ, ৫৫০টি নদী হারিয়ে গেছে। বাকিগুলোর অবস্থাও খুব খারাপ। পাউবো ৮ হাজার নদী, উপনদী ও খাল পেয়েছে যেগুলো পানির অভাবে মরতে বসেছে। অনেক স্থানে বড় নদীর সঙ্গে সংযুক্ত নদীর মুখে চর পড়েছে। এগুলো দ্রুত ড্রেজিং করে পানি প্রবাহ না বাড়ালে মরে যাবে। দখল রোধ, নদীর পাড়ে হাট-বাজারের রেজিস্ট্রি বন্ধ করতে হবে। নিয়মিত ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি উজান থেকে পানি আনতে হবে। তাহলেই নদীগুলো বাঁচানো যাবে। আর নদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না।

এদিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি এসব নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও অন্যান্য জলাশয়ের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে নদ-নদী দখল রোধের পাশাপাশি নিয়মিত খননের মাধ্যমে নাব্য ধরে রাখতে হবে। নাব্য বাড়াতে নদ-নদী, খাল-বিলের ওপর থেকে পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টিকারী ছোট ছোট ব্রিজ-কালভার্ট অপসারণ, নতুন ব্রিজ নির্মাণের আগে পরিবেশগত প্রভাব যাচাই ও হাইড্রোমরফোলজিক্যাল স্টাডি করা, নিয়মিত ড্রেজিং এবং খননকৃত মাটি/বালু কোনোমতেই নদী ও নদীর পাড়ে না ফেলার সুপারিশ করেছে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নদ-নদীগুলোর করুণ চিত্র।

রাজশাহী : রাজশাহীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এক সময়ের খরস্রোতা পদ্মা নদী এখন বালুচর। বাকি যেসব শাখা নদী আছে তার বেশির ভাগই চেনার উপায় নেই। পদ্মাপাড়ের বাসিন্দারা বলছেন, রাজশাহী শহরের তীরঘেঁষে চর জাগায় প্রতিনিয়ত সরে যাচ্ছে পদ্মার গতিপথ। গোদাগাড়ী উপজেলার বালিয়াঘাটা থেকে সুলতানগঞ্জ পর্যন্ত মহানন্দা নদীর প্রায় ১৫ কিলোমিটার এবং সুলতানগঞ্জ মোহনা থেকে প্রেমতলী পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার পদ্মা নদীর ৬০ ভাগ এলাকায় পানি নেই। ৪০ ভাগ এলাকায় পানি থাকলেও গভীরতা খুবই কম। নদীর মাঝে অসংখ্য ডুবোচর। নগরীর তালাইমারী এলাকায় ছিল খরস্রোতা স্বরমঙ্গলা নদীর উৎসমুখ। এখন নদী বলে এর কোনো পরিচয় নেই। বারাহী নদীর উৎসমুখ রাজশাহী নগরীর ফুদকিপাড়া মহল্লায় পদ্মা থেকে। উৎস থেকে প্রথম পাঁচ কিলোমিটারে নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। বাকি ১৫ কিলোমিটার অংশও মৃতপ্রায়। স্বরমঙ্গলা নদীর শাখা দয়া নদী এখন একটি বন্ধ পুকুরে পরিণত হয়েছে। জেলার ঐতিহাসিক একটি নদী নারদ। এই নদীর রাজশাহীর প্রায় ৩৫ কিলোমিটার প্রবাহ পথে পাঁচটি নীলকুঠি ছিল। বর্তমানে এর উৎসমুখসহ প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশ সম্পূর্ণ বেদখল হয়ে ফসলি মাঠ ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। বাকি অংশ মৃতপ্রায়। নারদের শাখা সন্ধ্যা নদীতে শুষ্ক মৌসুমে একেবারেই পানি থাকে না। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম শেখ জানান, রাজশাহী পানিবিজ্ঞান উপবিভাগের আওতায় থাকা রাজশাহী বিভাগের ১৩টি প্রধান নদীর মধ্যে ১১টি নদীর তলদেশ শুকিয়ে গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাত কমেছে। উষ্ণতা বাড়ছে। আবার পদ্মায় পানির প্রবাহ ঠিকমতো না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ পড়ছে। পানির লেভেল নিচে নেমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় মরুকরণের দিক ধাবিত হতে পারে এ অঞ্চল। তাই দ্রুত পদ্মার পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।

রাজবাড়ী : এ জেলাতেও শুকনো মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে পড়ছে পদ্মা নদী। মাঝ পদ্মায় এখন ধুধু বালুচর। সেখানে কৃষকরা ফসল বুনছেন। অনেক বালুচরে আগাছা আর বন-জঙ্গল তৈরি হয়েছে। রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, বর্ষায় পদ্মায় ৩১ ফিট পানি থাকে। বর্তমানে একটি চ্যানেলে ৭-৮ ফিট পানি থাকছে। সখান দিয়ে নৌযান যাতায়াত করছে। বেশির ভাগ জায়গার চর জেগেছে। এদিকে পদ্মায় মাছ ধরা জেলে পরিবারগুলো পেশা বদলে কেউ চালাচ্ছেন ইজিবাইক, কেউ দিনমজুরি করছেন।

বগুড়া : দখল, দূষণ ও ভরাট হয়ে ধীরে ধীরে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে যমুনা, বাঙ্গালি ও করতোয়াসহ উপনদীগুলো। যমুনা নদীটি বগুড়ার শেষ সীমানা শেরপুর ও ধুনট উপজেলার মধ্য দিয়ে রাজবাড়ী গিয়ে গোয়ালন্দঘাটে পদ্মার সঙ্গে মিশেছে। আন্তর্জাতিক নদী গবেষণা সংস্থার তথ্যমতে, যমুনা নদী এককালে রংপুর, বগুড়া, পাবনা ও ময়মনসিংহ জেলার পশ্চিম সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। খরস্রোতা, গভীর ও বিশাল চওড়া নদীটি এখন গভীরতা হারিয়ে মৃত্যুর ক্ষণ গুণছে। নদীর মাঝে অসংখ্য বালুচরে হচ্ছে ফসলের আবাদ। শুষ্ক মৌসুমে নদীর অনেক স্থান দিয়ে হেঁটেই পার হওয়া যাচ্ছে। অপরদিকে নীলফামারী জেলার তিস্তা নদী থেকে জন্ম নেওয়া বাঙ্গালি নদীর অনেক স্থানে পানি নেই। উজানে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ ও বর্ষাকালে নদীর তীর ভাঙনের ফলে তলদেশে পলি জমে নাব্য কমে যাচ্ছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় তলদেশে ফসলের আবাদ হচ্ছে। কোথাও আবার ব্রিজ না থাকায় নদী বক্ষে মাটি দিয়ে অস্থায়ী সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ১২২ কিলোমিটার করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে প্রাচীন পুন্ড্রনগরীর  গোড়া পত্তন হলেও সেই সভ্যতার সঙ্গে এখন করতোয়া নদীও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে। দখল আর ভরাটের কারণে এখন মরা নদী হিসেবে পরিণত হয়েছে নদীর প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকা। বগুড়ার পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, নদীগুলোর নাব্য কমে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে নদী ভরে ওঠে। এতে করে নদীর তীরে ভাঙন দেখা দেয়। নদী ভাঙার কারণে প্রতি বছর তলদেশে পলি জমে যাচ্ছে। এ ছাড়া প্রতি বছর উজান থেকে হাজার হাজার টন পলি আসছে। যে কারণে নদীগুলো মরে যাচ্ছে। নদীগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে মোট ২২৩ কিলোমিটার খনন করা হবে। এর মধ্যে করতোয়া নদী ১১৭ কিলোমিটার, সুবিল খাল ৩১ কিলোমিটার ও ইছামতি ও গজারিয়া নদী মিলিয়ে ৭৫ কিলোমিটার খননের প্রস্তাব করা হয়েছে। করতোয়া নদীর দুই পাড়ে সড়ক, ড্রেন, পানি শোধনাগার নির্মাণ হবে। নতুন সীমানা পিলার বসানো হবে। সব মিলিয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। একইভাবে ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, মেহেরপুর, হবিগঞ্জ, গাইবান্ধা, ফরিদপুর, দিনাজপুর, চুয়াডাঙ্গা, বরিশাল অঞ্চলের অধিকাংশ নদ-নদী নাব্য হারিয়ে মৃত্যুর ক্ষণ গুণছে বলে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর