বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

উচ্ছৃঙ্খলরা ভূলুণ্ঠিত করছে ছাত্ররাজনীতির গৌরব : হাই কোর্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির নামে কিংবা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে র‌্যাগিংয়ের নামে নবাগতদের অমানবিক নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন হাই কোর্ট। আদালত বলেছেন, এ কাজের মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খল ছাত্ররা দলের পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করছে। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনকে নির্যাতনের ঘটনায় করা রিটের আদেশের সময় গতকাল বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতির রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এসব মন্তব্য করেন।

শুনানি শেষে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সিলগালা করে পাঠানোর আদেশ দিয়ে ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জড়িত শিক্ষার্থী, অবহেলা করা হল প্রশাসনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিধি অনুসারে ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত ছাত্রলীগ নেত্রী অন্তরাসহ পাঁচ ছাত্রীর সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ও তাদের ক্যাম্পাসের বাইরে রাখতে বলা হয়েছে।

সাময়িক বহিষ্কার পাঁচ ছাত্রী হলেন- ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, হালিমা আক্তার ঊর্মি, ইসরাত জাহান মীম, তাবাসসুম ইসলাম ও মোয়াবিয়া জাহান। একই সঙ্গে দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শামসুল আলমকে অবিলম্বে সরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

এ ছাড়া ঘটনার সময় নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনের ভিডিও করা হালিমা আক্তার ঊর্মির মোবাইল ফোন সংগ্রহ এবং ধারণ করা ভিডিও উদ্ধার করে আদালতে দাখিল করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নির্ভয়ে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন চালিয়ে নিতে তিন দিনের মধ্যে আবাসিক হলে ফুলপরীর জন্য সিট বরাদ্দ দিতে বলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল কর্তৃপক্ষকে। সেই সঙ্গে কুষ্টিয়ার এসপি ও পাবনার এসপিসহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ফুলপরীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। ঘটনার সাক্ষীদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এ আদেশের বিষয়ে ৮ মের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সময় আদালতে আবেদনের পক্ষে ছিলেন রিটকারী আইনজীবী গাজী মো. মহসীন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক। শুনানিতে আদালত বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা খবরে দেখা যাচ্ছে, সম্প্র্রতি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্টভাবে আবাসিক হল ও হোস্টেলে কিছু উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থী তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের অপব্যবহার করে অপ্রত্যাশিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। এসব শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিতরে ঢুকে সাধারণ শিক্ষার্থী, বিশেষ করে নবাগতদের নির্যাতন করে। এ ধরনের অবাধ্য ছাত্ররা শিক্ষার মানসম্মত পরিবেশ বাধাগ্রস্ত করে। এমনকি নিজেদের দলীয় শৃঙ্খলাও ভঙ্গ করে। এর মাধ্যমে তারা দলের পাশাপাশি ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি ভূলুণ্ঠিত করছে। একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘বিচার তো আমরা করছি না। বিচার করবে বিশ্ববিদ্যালয়। তারা রিপোর্ট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখে সিদ্ধান্ত দেবে। আমরা উদ্বিগ্ন অন্য সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে। অনেক সময় রাজনৈতিক আশ্রয়ের অপব্যবহার করে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নষ্ট করে দিচ্ছে। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করো- এমন কথাও উঠতে পারে। তবে ছাত্ররাজনীতির যে প্রয়োজন, তা আমরা আমাদের ইতিহাস থেকে দেখেছি। কিন্তু এটাকে নষ্ট করার জন্য, ক্ষুণ্ন করার জন্য অনেকে না বুঝে করে, অনেকে বুঝে করে। এটা থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’

আদেশের সময় আদালত রিটকারী আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা বিষয়টি মনিটরিংয়ে রাখব। আপনিও এ বিষয়ে খেয়াল রাখবেন। কোনো সমস্যার উদ্ভব হলে আদালতকে জানাবেন। তখন আমরা প্রয়োজনীয় আদেশ দেব।’

১১ ফেব্রুয়ারি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে রাত সাড়ে ১১টা থেকে রাত প্রায় ৩টা পর্যন্ত শারীরিক নির্যাতন করা হয় নবীন ছাত্রী ফুলপরী খাতুনকে। ভুক্তভোগী ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। অভিযোগ ওঠে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীর অভিযোগ, তারা ওই শিক্ষার্থীকে মারধর করে তার বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে রাখেন।

এর মধ্যে বিষয়টি নিয়ে হাই কোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী মো. মহসীন। হাই কোর্ট প্রশাসন ক্যাডার, বিচার বিভাগ ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত কমিটির প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। সেই অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কমিটি এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন হাই কোর্টে পাঠানো হয়।

সর্বশেষ খবর