শিরোনাম
রবিবার, ১৯ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের উদ্বোধন হাসিনা-মোদির

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের উদ্বোধন হাসিনা-মোদির

দ্বিপক্ষীয় বোঝাপড়া আরও নিবিড় করল ঢাকা এবং নয়াদিল্লি। গতকাল বিকালে ‘বন্ধুত্বে’র (ফ্রেন্ডশিপ) পাইপলাইনের সূচনা করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পাইপলাইনটি উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ভারত থেকে পাইপলাইনে বাংলাদেশে তেল আসা শুরু হলো। আগে রেলে ওয়াগনে করে ভারত থেকে তেল আসত। এই প্রকল্পের প্রস্তাবিত খরচ ধরা হয়েছিল ৩৭৭ কোটি টাকা। তার মধ্যে ২৮৫ কোটি টাকা খরচ করা হয় শুধু বাংলাদেশের দিকে পাইপলাইন নির্মাণের জন্যই। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে ভারত থেকে পরিশোধিত ডিজেল পৌঁছবে বাংলাদেশের উত্তরের ৭টি জেলায়। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে এই প্রথম পাইপলাইন সংযোগ চালু হলো।

গতকাল বিকালে একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে যৌথভাবে ‘বন্ধুত্বে’র এই প্রকল্পের সূচনা করেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। ‘ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনকে’ দুই দেশের জন্য একটি মাইলফলক অর্জন বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর প্রকল্পের সূচনা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের ক্রমিক অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশের সেই উন্নয়নযাত্রার শরিক হতে পেরে প্রতিটি ভারতবাসী গর্ব অনুভব করছেন।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন আমাদের দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে সহযোগিতা উন্নয়নের একটি মাইলফলক অর্জন। এটি বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে। আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশ পাইপলাইনের মতো আগামী দিনেও আরও সফলতা বাংলাদেশ-ভারত উদযাপন করবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আমরা একসঙ্গে কাজ করব। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কথায় উঠে আসে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গও। বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে মোদি জানান, মুজিব যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নের কথা মাথায় রেখেই এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আগামী কিছুদিনের মধ্যেই রামপাল মৈত্রী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট চালু হয়ে যাবে। দুই দেশের মধ্যে উন্নয়নমূলক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত তৈরি হয়েছে। এই পাইপলাইনের সুফলের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন চালুর ফলে দুই দেশের জনগণ নানাভাবে উপকৃত হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যখন বিশ্বের অনেক দেশ জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি, এই পাইপলাইনটি আমাদের জনগণের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তিনি বলেন, এই পাইপলাইনে ভারত থেকে ডিজেল আমদানিতে ব্যয় ও সময় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ডিজেলের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করবে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু, ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবাধ প্রবাহ। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক সেতুবন্ধ দুই দেশের সম্পর্ককে আরও ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর করেছে। ক্রমাগত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সহযোগিতা আরও গভীর হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাবনাকে আমরা বাস্তবে রূপদান করেছি। আমাদের দুই দেশের মধ্যে সমস্যাগুলো একে একে আমরা সমাধান করেছি। যোগাযোগ স্থাপন করেছি, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়েছি। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি এবং ভারতের কাছ থেকে বিভিন্ন সহযোগিতা পাচ্ছি। দুই দেশের জনগণের কল্যাণে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে পারস্পরিক সহযোগিতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দুই দেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক সেটাই আমরা চাই। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে, সেটাকে আমরা কার্যকর করতে চাই। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বাংলাদেশে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। আমি চাই ভারতের বিনিয়োগকারীরাও এখানে বিনিয়োগ করুক। আমরা দুই দেশই তাতে লাভবান হব। ভারত থেকে বাংলাদেশের ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে উপ-আঞ্চলিক পর্যায়সহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার আরও কয়েকটি উদ্যোগ বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কৃতজ্ঞ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার এবং জনগণ অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ১ কোটি বাঙালি শরণার্থীকে স্থান দেওয়া, খাবারের ব্যবস্থা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দেওয়া এবং অস্ত্র দেওয়া- এসব সহযোগিতা ভারতের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বাহিনীর অভিযানে আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি। ১৯৭৫ সালের পর ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে ভারতের সরকার ও জনগণের কাছে ঋণী। আমরা দুই বোন তখন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমাদের আরও আত্মীয়স্বজন যারা বেঁচে গিয়েছিল তারাও ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। কাজেই আমি ভারতের কাছে, ভারতের জনগণের কাছে, সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। জানা যায়, দেশের উত্তরাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্বালানি তেল সরবরাহ ব্যবস্থা আরও সহজতর, নির্বিঘ্ন ও সুদৃঢ় নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। এতে আশার আলো দেখছেন উত্তরাঞ্চলবাসী। দীর্ঘদিনের জ্বালানি সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে উত্তরের ১৬ জেলার মানুষ। নিরবচ্ছিন্নভাবে জ্বালানি তেল সরবরাহের পাশাপাশি এ অঞ্চলের কৃষি ও ব্যবসা বাণিজ্যে ব্যাপক অবদান রাখবে। এ পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় মোট ১৩১ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশ অংশে ১২৬ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার এবং ভারত অংশে ৫ কিলোমিটার। ভারত সরকার আইবিএফবিএলের ভারতীয় অংশের ৫ কিলোমিটার পাইপলাইন এবং বাংলাদেশ অংশের ১২৬ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণে অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করেছে। বাংলাদেশ অংশে এই আপৎকালীন তেল ডিপো নির্মাণের ফলে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নির্বিঘ্নে জ্বালানি তেল আমদানি ও গ্রহণ নিশ্চিত হবে। পূর্বে রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে ৬০ থেকে ৭০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল আমদানি করা যেত। বর্তমান চাহিদা অনুযায়ী বার্ষিক প্রায় ২ দশমিক ৫ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল ভারত থেকে আমদানি করা সহজতর হবে। পার্বতীপুর রেলহেড ডিপোর জ্বালানি তেলের চাহিদা পূরণের জন্য প্রথমে চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে খুলনার দৌলতপুর ডিপোতে তেল সরবরাহ করা হতো। পার্বতীপুর রেলহেড ডিপো থেকে ৮০০ থেকে ১ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেল উত্তরের ১৬ জেলাতে সরবরাহ করা যাবে। এই রিসিভ টার্মিনাল নির্মাণের ফলে পার্বতীপুরে অতিরিক্ত ২৯ হাজার মেট্রিক টনের জ্বালানি তেলের মজুদ বৃদ্ধি পেয়ে মজুদ ক্ষমতা দাঁড়াবে ৪৩ হাজার মেট্রিক টন। উত্তরের ১৬ জেলায় নিরবিচ্ছন্নভাবে ডিজেল সরবরাহ ও নীলফামারীর সৈয়দপুরের ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ভারত থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল (ডিজেল) আমদানির রিসিভ টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাইপলাইন নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৫ বছর মেয়াদি এই প্রকল্প ভারতের নুমালীগড় রিফাইনারি লিমিটেড এবং বাংলাদেশের মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর