সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

জলবায়ু পরিবর্তনে পুড়ছে দেশ

► মরুভূমির গরম নিয়ে বইছে নজিরবিহীন দাবদাহ ► বিশেষজ্ঞরা বলছেন বৃক্ষনিধন, নদী হত্যা, বায়ুদূষণ ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই এ পরিণতি

জিন্নাতুন নূর

জলবায়ু পরিবর্তনে পুড়ছে দেশ

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েক দিন ধরে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। এ তাপপ্রবাহ মরুভূমির মতো গরম নিয়ে বইছে নজিরবিহীনভাবে। এতে ঘরের বাইরে যারাই বের হচ্ছেন তাদের গায়ে জ্বালাপোড়া করছে। এবার অতিরিক্ত তাপমাত্রার সঙ্গে নতুন সমস্যা হচ্ছে, অনেকেরই ঠোঁট ফেটে যাচ্ছে। আর এটি হচ্ছে বাতাসে জলীয় বাষ্পের ঘাটতির কারণে। বিশেষজ্ঞরা এ অবস্থার জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। তারা পাশের দেশগুলোর নির্গত মাত্রাতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাসকে বাংলাদেশের উষ্ণায়নের জন্য দায়ী করছেন। এর সঙ্গে বৃক্ষনিধন, নদী হত্যা ও ভরাট, বায়ুদূষণ, খোলা জায়গার অভাবসহ মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোকেও তাপপ্রবাহের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। জলবায়ু-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে এখন থেকেই যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ৩০ বছরের মধ্যে গ্রীষ্মকালে দেশে গড় তাপমাত্রা ৩ থকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। আর বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা তখন ৪৬ ডিগ্রি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশনের (সিইজিআইএস) হিসাবে ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে তাপমাত্রা বেড়েছে ০.০০৬৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ১৯৯১ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বেড়েছে গড়ে ০.৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত গড়ে ১.০৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে কানাডার ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশের ছয়জন গবেষক ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটসহ পাঁচ শহরের ওপর গবেষণা করে দেখেন, বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি যেখানে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা হচ্ছে, সেখানে ঢাকার তাপমাত্রা গত ২০ বছরে প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণায় ঢাকার তাপমাত্রা বেশি বৃদ্ধির পেছনে জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমি ভরাট ও গাছপালা কেটে ফেলাকে দায়ী করা হচ্ছে। গবেষণায় বলা হয়, ঢাকাসহ অন্য মহানগরগুলো পরিণত হচ্ছে ‘হিট আইল্যান্ড’ বা উত্তপ্ত দ্বীপে। এ দ্বীপের আশপাশে তাপমাত্রা কম থাকলেও দ্বীপটি দিনরাতই উত্তপ্ত থাকছে। এ ছাড়া বিগত তিন দশকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা এর আগের তিন দশকের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৭ উপলক্ষে প্রকাশিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যানে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যখন আমরা দেখি যে দীর্ঘ সময় ধরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন ধরে নিতে হবে যে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই হচ্ছে। সাধারণত কানাডার ভ্যানকুভারে তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ওঠে না। কিন্তু সম্প্রতি আমরা দেখেছি যে, গ্রীষ্মকালে সেখানে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠে গিয়েছে। এটি স্পষ্টভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হয়েছে। আমি মনে করি বর্তমানে দেশে যে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, এর জন্য জলবায়ু পরিবর্তন দায়ী। আর এর সঙ্গে গাছ কাটা, নদী দখলের মতো মানবসৃষ্ট কারণও দায়ী।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শফিক-উর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া বৈশ্বিক উষ্ণতা তথা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলাফল। এটি বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত। আমাদের দেশে তাপমাত্রা ৪১ বা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও এটি আরও ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি অনুভূত হয়। আর এমন হওয়ার মূল কারণ শহর এলাকায় গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে যাওয়া। ঢাকায় যদি প্রচুর খোলা জায়গা, পার্ক, জলাশয় ও সবুজ জায়গা থাকত তাহলে মাত্রাতিরিক্ত এ গরম অনুভূত হতো না। শহর এলাকায় কংক্রিটের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু গাছপালা ও জলাশয়ের পরিমাণ কমেছে। আর এগুলো বেশি পরিমাণে থাকলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আমরা যে কষ্ট অনুভব করছি তা থাকত না। শহরে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। খোলা জায়গা ও মাঠের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। গত পাঁচ দশকে আমরা সোহরাওয়ার্দী ও রমনা পার্কের মতো আর দুটো পার্ক বানাতে পারিনি। ঢাকার পাশে যে গজারিবন ছিল তাও কমে এসেছে। জলাশয় যা কমে গিয়েছে তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। যে জলাশয়গুলো আছে সেগুলো যেন ভরাট না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ঢাকার রাস্তার পাশে এবং ডিভাইডারের মাঝের জায়গায় গাছ লাগানো যেতে পারে। এতে গরমে যখন রাস্তার পাশের ভবনগুলোতে বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হয় তখন গাছ থাকায় এত গরম অনুভূত হবে না।’

সর্বশেষ খবর