সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

তওবা : গুনাহমুক্ত জীবনের চাবিকাঠি

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

তওবা : গুনাহমুক্ত জীবনের চাবিকাঠি

তওবা শব্দটি আরবি, অর্থ ‘রুজু ইলাল্লাহ’ আল্লাহর দিকে ফিরে আসা। মানুষ বুঝে বা না বুঝে গুনাহ করার পর যখন একান্ত মনে গুনাহ স্বীকার করে, লজ্জিত হয়ে, ভবিষ্যতে এই গুনাহ না করার সংকল্প নিয়ে আল্লাহর কাছে ফিরে আসে তাকে মূলত তাওবা বা ‘রুজু ইলাল্লাহ’ বলে। পবিত্র কোরআনে ‘সুরা তাওবা’ নামে একটি সুরাও নাজিল হয়েছে। আল্লাহ রব্বুল আলামিন মানুষের এই ফিরে আসাকে খুবই পছন্দ করেন। কারণ তিনি মানব জাতিকে তার ভালো-মন্দ কর্মের জ্ঞান দান করেছেন। আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত হয়ে মানুষ যখন মন্দ কর্ম বাদ দিয়ে সৎ কর্ম গ্রহণ করে তখন রব্বুল আলামিন তার ওপর বড়ই খুশি হয়ে থাকেন। ইরশাদ হচ্ছে- ‘অতঃপর তাকে (মানুষকে) তার মন্দ কর্ম ও সৎ কর্মের জ্ঞান দান করেছেন।’ (সুরা শামস : ৮) আল্লাহতায়ালা প্রতিটি মানুষের মাঝে দুটি নফস রেখেছেন। একটি তাকে সৎ কাজের প্রতি আকৃষ্ট করে, অন্যটি অসৎ কাজের দিকে ইশারা করে। আল্লাহতায়ালা তাঁর বিশেষ রহমতে হজরতে আম্বিয়ায়ে কেরামদের নিষ্পাপ রেখেছেন। এ ছাড়া মানবীয় বৈশিষ্ট্যের কারণে সব মানুষের অন্তরে গুনাহের প্রতি ওয়াসওয়াসা ও তা থেকে বেঁচে থাকার পন্থা উভয়টিই রয়েছে। তবে তিনি নেককার মানুষদের গুনাহ থেকে দূরে রাখেন তাঁর বিশেষ রহমতে। বিশেষ করে হজরতে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবেতাবেয়িন ও আউলিয়া কেরামগণ নবীর আদর্শে নিজেদের সব ধরনের গুনাহ থেকে মুক্ত রাখতেন। তাইতো হযরতে সাহাবায়ে কেরামদের সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের প্রতি খুশি হয়েছেন। যখন তাঁরা গাছের নিচে তোমার কাছে বায়আত গ্রহণ করেছিল। তাঁদের অন্তরে যা কিছু ছিল সে সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। তাই তিনি তাদের ওপরে অবতীর্ণ করলেন প্রশান্তি এবং পুরস্কারস্বরূপ তাদের দান করলেন আসন্ন বিজয়’ (সুরা আল ফাতাহ : ১৮)। উক্ত আয়াতে মুমিন বলে সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)কে বুঝানো হয়েছে। তাঁদের ওপর আল্লাহ রব্বুল আলামিন সন্তুষ্ট, তাঁরাও আল্লাহতায়ালার (সব ফয়সালার) ওপর সন্তুষ্ট।

ক্ষমা প্রার্থনা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নিজ প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল।’ (সুরা নূহ: ১০) মৌলিকভাবে আল্লাহতায়ালা তামাম সৃষ্টির ওপর অনেক অনেক দয়াবান ও মেহেরবান। তিনি তো রহমান, তিনি তো রহিম। দেখুন না! প্রতিটি মানুষের কাঁধে কিরামান কাতিবিন দুজন সম্মানিত ফেরেশতা আছে। একজন ডান কাঁধে। সে এই লোকটির সৎকর্মগুলো লেখে। অপরজন বাম কাঁধে। যে তার মন্দ কর্মগুলো লেখে। লোকটি যখন কোনো সৎ কাজের ইচ্ছা করে সঙ্গে সঙ্গে ডান কাঁধের ফেরেশতা তার আমলনামায় একটি নেকি লিখে দেন। কাজটি সম্পাদনের পর দশটি নেকি লিখে। সুবহানাল্লাহ। পক্ষান্তরে যদি লোকটি কোনো মন্দ কাজের ইচ্ছা করে, তাহলে বাম কাঁধের ফেরেশতা কোনো গুনাহ লেখে না। যখন সে ওই কাজটি বাস্তবায়ন করে তখনো ফেরেশতা কোনো গুনাহ লিখে না। বরং সে ডান কাঁধের ফেরেশতার কাছে লেখার অনুমতি চায়। ডান কাঁধের ফেরেশতা বলে, একটু অপেক্ষা কর হয়তো সে তওবা করে ফিরে আসবে। কিছুক্ষণ পর আবার অনুমতি চাইলে ওই ফেরেশতা বলে, আরেকটু অপেক্ষা কর। এরপর তৃতীয়বার যখন বাম কাঁধের ফেরেশতা ডান কাঁধের ফেরেস্তার কাছে অনুমতি চায় আর বান্দা তখনো পর্যন্ত তওবা না করে, তখন তাকে বলা হয় একটি গুনাহ লিখ। ‘আল্লাহু আকবর’ তিনি কতই না ক্ষমাশীল ও দয়াবান। তিনি বান্দার গুনাহ করার পর সুযোগ দেন যেন সে তওবা করে। ক্ষমা প্রার্থনা করে। ফেরেস্তা দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটি গুনাহ লেখার পরও তওবার দরজা তার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত খোলা থাকে। খাঁটি মনে তওবা করলে রব্বুল আলামিন জীবনের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন। তওবা মূলত তিনটি জিনিসের সমষ্টি। এক. যে গুনাহের কারণে তওবা করা হচ্ছে তার ব্যাপারে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া। দুই. ওই গুনাহ থেকে তৎক্ষণাৎ দূরে সরে আসা। তিন. ভবিষ্যতে সেই গুনাহে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা। এভাবে তওবাকারী সম্পর্কে হাদিসে এসেছে- ‘গুনাহ থেকে তওবাকারী এমন হয় যেন তার কোনো গুনাহ নেই।’ (ইবনে মাজাহ : ৪৩০৪)

আমরা প্রত্যেকেই নিজ সম্পর্কে খুব ভালো জানি, আমি জীবনে কী কী নাফরমানি করেছি। কখন কোথায় কীভাবে আল্লাহ ও বান্দার হক নষ্ট করছি। তা স্মরণ করে আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। বান্দার হক নষ্ট করে থাকলে বান্দা থেকে ক্ষমা চেয়ে তা মাফ করিয়ে নিতে হবে। বান্দার হক বান্দা মাফ না করলে আল্লাহ মাফ করেন না। নাজাতের দিনগুলোতে তওবা করার এক মোক্ষম সুযোগ। আল্লাহপাক এই সময়ে বহু গোনাহগার বান্দাকে ক্ষমা করেন। এক হাদিসে এসেছে- ‘একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিম্বরে আরোহণ করার সময় তিনবার আমিন বলেন। সাহাবায়ে কেরাম সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, এর মধ্যে দ্বিতীয়বার আমিন বলেছি যখন আমি আরোহণ করছিলাম জিবরাইল আমিন আমার কাছে এসে বললেন, যে ব্যক্তি রমজান মাস পেয়ে নিজের গুনাহ ক্ষমা করাতে পারল না সে ধ্বংস হোক। আমি তাঁর উত্তরে বলেছি, আমিন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৯০৮) তাই আসুন! আমরা খাঁটি মনে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং নিজেদের গুনাহগুলো ক্ষমা করিয়ে নিই। তাহলে আমরা গুনাহমুক্ত জীবন লাভ করতে পারব এবং সার্থক হবে রমজান পালন। গুনাহ থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হলো- সদা-সর্বদা ইস্তেগফার পাঠ করা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি আল্লাহতায়ালার কাছে প্রতিদিন একশ বার ইস্তেগফার করি।’ (সহিহ মুসলিম : ২৭০২) রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম নবুয়তের পূর্বাপর নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও দৈনিক ৭০ থেকে ১০০ বার ইস্তেগফার পড়তেন। আমরা তো গুনাহগার আমাদের দিনে কতবার ইস্তেগফার পড়া উচিত? বিষয়টিতে বুঝে আমল করার অনেক বড় খোরাক রয়েছে। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে গুনাহমুক্ত জীবন ধারণ করার তওফিক দান করুন। আমিন

সর্বশেষ খবর