শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

নতুন রাষ্ট্রপতির অপেক্ষায় বঙ্গভবন

বিদায় হামিদ, স্বাগত শাহাবুদ্দিন

রফিকুল ইসলাম রনি

নতুন রাষ্ট্রপতির অপেক্ষায় বঙ্গভবন

দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ২৪ এপ্রিল সোমবার শপথ নেবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহাবুদ্দিন। ওইদিন বেলা ১১টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে নতুন রাষ্ট্রপতিকে শপথবাক্য পাঠ করাবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। নতুন রাষ্ট্রপতির অপেক্ষায় বঙ্গভবন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘসময় এবং সফলভাবে দায়িত্ব পালনকারী মো. আবদুল হামিদের উত্তরসূরি মো. শাহাবুদ্দিন। তাঁর শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বিদায় জানানো হবে টানা ১০ বছর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করা মো. আবদুল হামিদকে। বঙ্গভবনে স্বাগত মো. শাহাবুদ্দিন, বিদায় মো. আবদুল হামিদ।

নতুন রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত ও বিদায়ী রাষ্ট্রপতিকে বিদায় জানাতে প্রস্তুত বঙ্গভবন। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর এই প্রথম কোনো রাষ্ট্রপতিকে বড় ধরনের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতাসহ মন্ত্রিসভার সদস্যগণ, রাজনীতিবিদ, সশস্ত্র বাহিনী প্রধানগণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিদেশি কূটনীতিক, শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এবং পেশাজীবী সংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ইতোমধ্যে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়েছে। শপথ অনুষ্ঠানে ১ হাজার ২৩৮ জনকে দাওয়াতপত্র পাঠানো হয়েছে। বিদায়ী রাষ্ট্রপতিও তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ, আবার নতুন রাষ্ট্রপতিও তৃণমূল থেকে গড়ে ওঠা রাজনীতিক। দুজনই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য।

স্বাগত মহামান্য রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন : বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রতিবাদ করায় জেলে যেতে হয় তাঁকে। জেলখানায় তাঁকে ডান্ডাবেরি পরিয়ে রাখা হতো। বর্ণাঢ্যময় কর্মজীবনে শাহাবুদ্দিন ছিলেন একাধারে আইনজীবী, অধ্যাপক, সাংবাদিক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত সমন্বয়কারী, বিচারক ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক কমিশনার। দুদক থেকে অবসরে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের ‘থিঙ্কট্যাংক খ্যাত’ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি পত্র-পত্রিকায় নিয়তিম কলাম লিখতেন। ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির চেয়ারম্যান। শহীদ বুলবুল কলেজের অধ্যাপকও ছিলেন তিনি। অধুনালুপ্ত বাংলার বাণী পত্রিকার পাবনা জেলা প্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন মো. শাহাবুদ্দিন। পাবনা প্রেস ক্লাব ও অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. শাহাবুদ্দিনকে ১২ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয়। ওই দিন দুটি মনোনয়নপত্র তাঁর নামে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে বৈধ ঘোষণা করেন নির্বাচন কমিশন। ওই দিনই মো. শাহাবুদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

মো. শাহাবুদ্দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ আহ্বানে ১৯৬৬ সালে ছাত্র-রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং তাঁর স্নেহের পরশ লাভ করেন। ১৯৬৬ সাল জাতির পিতা পাবনাতে ৬ দফা প্রচারে যান। সেখানে শাহাবুদ্দিন প্রথম জাতির পিতার সান্নিধ্য লাভ করেন। সেই থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত অনেকবার তাঁর সঙ্গ সান্নিধ্য লাভ করেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মাঠের রাজনীতিক মো. শাহাবুদ্দিন ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর পাবনা শহরের শিবরামপুরের জুবিলী ট্যাংক পাড়ায় জš§গ্রহণ করেন। তাঁর ডাকনাম চুপ্পু। পিতা শরফুদ্দিন আনছারী, মাতা খায়রুন্নেসা। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে পাবনা শহরেই। শহরের পূর্বতন গান্ধী বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে রাধানগর মজুমদার একাডেমিতে ভর্তি হন চতুর্থ শ্রেণিতে। সেখান থেকে ১৯৬৬ সালে এসএসসি পাসের পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়ে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন মো. শাহাবুদ্দিন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি পান। ছাত্রাবস্থায় ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পাবনা জেলার নেতা হিসেবে পাবনায় স্বাধীন বাংলার প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী। তৎকালীন বৃহত্তর পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী থেকে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। অংশগ্রহণ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। এরপর জেলা যুবলীগের সভাপতি হন। জাতির পিতা বাকশাল গঠন করলে তিনি পাবনা জেলা বাকশালের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৭২ সালে পাবনার নগরবাড়ী ঘাট জনসভা এবং পাবনা স্টেডিয়ামের জনসভায় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. শাহাবুদ্দিনের বক্তব্য শুনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বুকে জড়িয়ে আশীর্বাদ করেন এবং হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে আসেন।

চাকরি জীবনে ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে পরপর দুবার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন তিনি। বিচারালয়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন শেষে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে ২০০৬ সালে অবসরে যান মো. শাহাবুদ্দিন। এরমধ্যে শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান পদেও তিনি ছিলেন।

দুদক কমিশনার হিসেবে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিরুদ্ধে ওঠা তথাকথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় দৃঢ়তার পরিচয় দেন। একজন অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী, বিনয়ী ও দৃঢ়চেতা মানুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহাবুদ্দিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অতন্দ্র প্রহরী। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পরপরই আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা হয়। সে সময়ের ‘হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের’ মতো ঘটনার পরবর্তীতে ক্ষমতায় গিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করে আওয়ামী লীগ। ওই কমিশনের প্রধান ছিলেন শাহাবুদ্দিন, যা শাহাবুদ্দিন কমিশন নামেই পরিচিত। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিলে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ব্যক্তিগত জীবনে শাহাবুদ্দিন চুপ্পু এক ছেলের বাবা। তাঁর স্ত্রী রেবেকা সুলতানা যুগ্ম সচিব ছিলেন। একমাত্র ছেলে আশরাদ আদনাম রনি।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়ে টানা ছয় দিনের কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকবেন মো. শাহাবুদ্দিন। ২৫ এপ্রিল বেলা পৌনে ১২টায় সাভার জাতীয় স্মৃতি সৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দুপুর পৌনে ১টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা এবং সোয়া ১টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। ২৬ এপ্রিল টুঙ্গিপাড়ায় যাবেন রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিন। ওইদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় জাতির পিতার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন তিনি। ২৭ এপ্রিল সোয়া ১১টায় ঢাকা সেনানিবাসে শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ, পৌনে ১২টায় বনানী কবরস্থানে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

বিদায় বাংলাদেশের দীর্ঘ সময়ের সফল রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ : নতুন রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিনকে শপথ পড়ানোর পর বিদায় জানানো হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সফলভাবে দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে। বঙ্গভবন ছেড়ে যাওয়ার আগে আবদুল হামিদ এখানে রেখে যাবেন নানা সুখস্মৃতি। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার রেকর্ডও বঙ্গভবনের রেকর্ডবুকে রেখে যাবেন এই বর্ষীয়ান রাজনীতিক। বিচক্ষণ, বিনয়ী, সদালাপী, পরোপকারী এবং বিতর্কমুক্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবেও নিজের নামটি রেখে যাবেন লাখো-কোটি মানুষের হৃদয়ে। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। এর পর থেকে গত ৩৩ বছরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের কারও কারও বঙ্গভবন ছাড়তে হয় বিতর্ক সঙ্গে নিয়ে; কিন্তু সজ্জন রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত আবদুল হামিদকে কোনো বিতর্ক স্পর্শ করতে পারেনি। সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ মো. আবদুল হামিদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। একই বছরের ২০ মার্চ রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান মৃত্যুবরণ করলে আবদুল হামিদ সেদিন থেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এর এক মাস পর ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। একই বছরের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ২৪ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সব মিলিয়ে টানা ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন আবদুল হামিদ। এর আগে আর কোনো রাষ্ট্রপতি এত দীর্ঘ সময় বঙ্গভবনের বাসিন্দা ছিলেন না।

এদিকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিদায় অনুষ্ঠান ঘিরে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রাজকীয় বিদায়ের জন্য প্রস্তুত রয়েছে বঙ্গভবন। বঙ্গভবনের ক্রেডেনশিয়াল গ্রাউন্ডে বিদায়ী গার্ড অব অনার প্রদানের মধ্য দিয়ে মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। ক্রেডেনশিয়াল গ্রাউন্ডে গার্ড অব অনার এবং প্রধান ফটকে স্যালুট গার্ড প্রদান করবে প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড রেজিমেন্ট। অন্যদিকে অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতিকে বহন করবে সুন্দর সাজানো গাড়ি। বঙ্গভবনের সব কর্মকর্তা দুই দলে ভাগ হয়ে গাড়ির সামনে দড়ি ধরে দাঁড়াবেন। তারপর গাড়ি সামনে অগ্রসর হবে। বঙ্গভবনে দীর্ঘ অবস্থানের সমাপ্তি শেষে আবদুল হামিদ বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর (এসএসএফ) তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে একটি ভিভিআইপি মোটর শোভাযাত্রায় নিকুঞ্জ এলাকায় তাঁর নতুন বাসভবনের উদ্দেশে রওনা হবেন। একজন পরোপকারী, বিনয়ী, সদালাপী এবং প্রচারবিমুখ ব্যক্তি। সমাজের সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে সুন্দর ও হƒদয়গ্রাহী আচার-আচরণের জন্য তিনি সুপরিচিত। তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত। দরিদ্র জনগণের জন্য রয়েছে তাঁর অকৃত্রিম দরদ ও ভালোবাসা। আবদুল হামিদ বিবাহিত। তিনি তিন পুত্র ও এক কন্যার জনক। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সম্মানে ১৭ এপ্রিল বঙ্গভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এক বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে আবদুল হামিদ তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, তিনি রাষ্ট্রপতি হলেও নিজেকে সব সময় দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই মনে করতেন। আবদুল হামিদ বলেন, রাষ্ট্রপতির পদকে দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করে তিনি তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। বঙ্গভবনের উন্নয়নে তাঁর গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বঙ্গভবন মর্যাদার প্রতীক। আবদুল হামিদ শুধু সংস্কার করা এয়ার রেইড শেল্টার ও বঙ্গভবনের তোষাখানা জাদুঘর উদ্বোধন করেননি, বঙ্গভবনের কিছু অংশ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্তও করেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দেশে দুটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

আবদুল হামিদ ১৯৪৪ সালে ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের কামালপুর গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম হাজি মো. তায়েব উদ্দিন এবং মাতার নাম মরহুমা তমিজা খাতুন। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার নিকলী জি.সি. হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ ও বিএ ডিগ্রি এবং ঢাকার সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের কারণে ১৯৬৮ সালে তিনি আবারও কারাবরণ করেন। ১৯৬৯ সালের শেষ পর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তিনি ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর ১৯৭৬-৭৮ সালে তৎকালীন সামরিক ও বিএনপি সরকারের সময় তিনি কারারুদ্ধ হন। তিনি ১৯৭৮ থেকে ২০০৯ সালের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একজন সমাজসেবক ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক মো. আবদুল হামিদ প্রায় ৭৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৪টি উচ্চ বিদ্যালয় ও ৩টি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

আবদুল হামিদ ১৯৭০ সালে ময়মনসিংহ-১৮ থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ১৯৭২ সালে গণপরিষদ সদস্য, ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে, ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচন হন।

আবদুল হামিদ সপ্তম জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১৩ জুলাই ১৯৯৬ থেকে ১০ জুলাই ২০০১ পর্যন্ত এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি সম্মানিত স্পিকার নির্বাচিত হন এবং ১২ জুলাই ২০০১ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০০১ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। অষ্টম জাতীয় সংসদে তিনি ২০০১ সালের ১ নভেম্বর থেকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে স্পিকার নির্বাচিত হন এবং সফলভাবে এ দায়িত্ব পালন করেন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি কার্য উপদেষ্টা কমিটি, কার্যপ্রণালি বিধি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি, বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং পিটিশন কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

যেভাবে হবে শপথ অনুষ্ঠান : রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে অন্তত পাঁচটি কমিটি গঠন করা হয়। গত ৬ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মাহমুদুল হাসান খানের নেতৃত্বে সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির মূল কাজ শপথ অনুষ্ঠান উপলক্ষে গঠিত বাকি চারটি উপকমিটির কার্যক্রম সমন্বয় করা এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সার্বিক চিত্র অবহিত করা। অন্য কমিটিগুলো হলো অতিথি তালিকা প্রণয়ন কমিটি, আমন্ত্রণপত্র প্রাপ্তি যাছাই কমিটি, আসন ব্যবস্থাপনা কমিটি ও অভ্যর্থনা কমিটি।

শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ১ হাজার ২৩৮ জনকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠান বঙ্গভবনে হয়। রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী, শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের আপন বিভাগের। অতিথিদের দাওয়াত দেওয়া থেকে শুরু করে প্রটোকল-সংক্রান্ত সার্বিক দায়িত্ব পালনে নেতৃত্বে থাকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। বঙ্গভবনকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা ও আপ্যায়নের নেতৃত্ব দেয় আপন বিভাগ। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব।

সর্বশেষ খবর