শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

হাসিমুখে ঈদযাত্রা

টিকিটের বাড়তি দাম নিয়ে অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাসিমুখে ঈদযাত্রা

পবিত্র শবেকদরের ছুটির পরদিন নির্বাহী আদেশে এক দিনের ছুটি ঘোষণা করার সুফল মিলেছে ঈদযাত্রায়। এতে আজ থেকে তিন দিনের ঈদের ছুটি শুরু হলেও ১৮ তারিখ রাত থেকেই গ্রামের বাড়িতে ফিরতে শুরু করেন মানুষ। একসঙ্গে সড়কে চাপ না পড়ায় সড়ক-মহাসড়কে দেখা যায়নি তেমন কোনো যানজট। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া এবারের ঈদে অনেকটা নির্বিঘ্নেই বাড়ি ফিরতে পারছেন মানুষ। তবে দূরপাল্লার গণপরিবহন সংকট ও বাসগুলোয় ইচ্ছামতো টিকিটের দাম বাড়ানোয় প্রতিবারের মতো এবারও ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বাধ্য হয়ে অনেককে ঝুঁকি নিয়ে ট্রাক বা পিকআপে চড়ে ঢাকা ছাড়তে দেখা গেছে। এবারও ট্রেনের টিকিট ছিল ‘সোনার হরিণ’। বেসরকারি অফিসগুলোয় বৃহস্পতিবার শেষ কর্মদিবস থাকায় গতকাল বিকাল থেকে সড়কে যানবাহনের চাপ বাড়ে।

এবার ১৯ এপ্রিল (বুধবার) ছিল পবিত্র শবেকদর উপলক্ষে ছুটি। ২১ থেকে ২৩ এপ্রিল তিন দিন ঈদের ছুটি। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ৩০ রোজা পূর্ণ হলে ছুটি বাড়বে আরও এক দিন। মাঝে ২০ এপ্রিল কর্মদিবস থাকলেও নির্বাহী আদেশে একদিন ছুটি ঘোষণা করে সরকার। টানা ছুটি পাওয়ায় ১৮ এপ্রিল (মঙ্গলবার) অফিস করেই বাড়ির পথ ধরেন অনেকে। আবার দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিকরা বেশি ভাড়া থেকে বাঁচতে ছুটি শুরুর দুয়েকদিন আগে থেকেই বাড়ি ফিরতে শুরু করেন। বাস ভাড়া বৃদ্ধি ও টিকিট না পাওয়ায় লাখ লাখ মানুষ এবার মোটরসাইকেলে বাড়ি ফিরেছেন। বুধবার ও বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু সেতুতে ছিল মোটরসাইকেলের দীর্ঘ লাইন। এদিকে শর্তসাপেক্ষে গতকাল থেকে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দেওয়ায় ভোররাতেই অনেক বাইকার সেতু এলাকায় অবস্থান নেন। সেখানেই সাহরি খান। ভোর ৬টায় টোলপ্লাজা খুলতেই প্রথম দুই ঘণ্টায় প্রায় ৩ হাজার মোটরসাইকেল সেতু পাড়ি দিয়েছে বলে জানিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গতকাল ঢাকা ও গাজীপুরের প্রবেশপথগুলোয় এবং কিছু কিছু আঞ্চলিক মহাসড়কে যানজট সৃষ্টি হলেও দেশের বেশিরভাগ মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। গতকাল বিকালে সাভারের নবীনগর থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত ১৮ কিলোমিটার সড়কে ছিল যানবাহনের ধীরগতি। আবদুল্লাহপুর বাইপাইল থেকে জামগড়া পর্যন্ত দুই কিলোমিটার, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের নবীনগর থেকে বিশমাইল পর্যন্ত চার কিলোমিটার, টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা-ভুয়াপুর-বঙ্গবন্ধু সেতু আঞ্চলিক সড়কের বিভিন্ন বাজার এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে যানজট সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জানিয়েছে, সড়কের পরিস্থিতি ও যানজট নিয়ন্ত্রণে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ১৩০টি ক্যামেরার মাধ্যমে যানজটপ্রবণ জায়গাগুলো পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। কোথাও যানজট হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে। ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে ঢাকার ২০টি পয়েন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ ৪৬টি পয়েন্টে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত রয়েছে। গতকাল দুপুরে ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক পরিদর্শন করে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের স্বস্তিতে বাড়ি ফেরা নিশ্চিত করতে পুলিশসহ সব সংস্থার সদস্যরা একযোগে কাজ করছে এবং মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক আছে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য-

সদরঘাট : পদ্মাসেতু চালুর পর যাত্রী সংকটে ভোগা দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চগুলোতে অবশেষ যাত্রীর চাপ বেড়েছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতে দেখা গেছে হাজার হাজার লঞ্চ যাত্রীকে। রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে ঈদে বাড়ি ফেরা ঘরমুখো মানুষের এসব চিত্র দেখা যায়। সপ্তাহের শেষ দিনের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং গার্মেন্ট কারখানাগুলো ছুটি হাওয়ায় এ ভিড় বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সদরঘাট লঞ্চ মালিক সমিতির নেতারা।

গাজীপুর : গাজীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে গতকাল ভোর থেকেই ঘরমুখী মানুষের চাপ বাড়ে। টঙ্গীর স্টেশন রোড, ভোগড়া বাইপাস মোড় এবং চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় মাঝেমধ্যেই গাড়ির দীর্ঘ সারি তৈরি হচ্ছিল। মহাসড়কের শৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন পয়েন্টে জেলা ও হাইওয়ে পুলিশের পাশাপাশি রোভার স্কাউট সদস্যদের কাজ করতে দেখা গেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কেও গাড়ির চাপ বাড়ে। গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) নাজমুস সাকিব খান জানান, মহাসড়কে হঠাৎ বাস ও যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) উপ-পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক বিভাগ) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, গতকাল গাজীপুরের ৭৭ ভাগ গার্মেন্ট ছুটি হয়েছে। অতিরিক্ত যাত্রী এসে চান্দনা চৌরাস্তায় ভিড় করছেন। খালি বাসগুলো চান্দনা চৌরাস্তা দিয়ে ঢুকছে। ফলে চান্দনা চৌরাস্তা প্যাক্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ক্লিয়ার করে ফেলার চেষ্টা করছি। গাড়ির গতি কমলেও যানজট নেই।

টাঙ্গাইল : আগের দুই দিনের চেয়ে গতকাল ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে যানবাহনের চাপ ছিল বেশি। তবে আগের সেই চিরচেনা যানজট কোথাও দেখা যায়নি। উত্তরবঙ্গগামী শ্যামলী পরিবহনের চালক রাইসুল ইসলাম জানান, এবার ঈদে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। কালিহাতীর এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার দুই লেনের সড়ক একমুখী (উত্তরবঙ্গমুখী) করায় এই মহাসড়কে দীর্ঘস্থায়ী কোনো যানজট লাগেনি।

সিরাজগঞ্জ : উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ মহাসড়ক এবার ঈদযাত্রায় স্বস্তি এনে দিয়েছে। ঈদের আগে মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট মেরামত ও পুলিশ প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের কারণে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন হয়েছে বলে মনে করছেন চালক ও যাত্রীরা। গতকাল সকাল থেকে মহাসড়কটিতে যানবাহনের চাপ থাকলেও যানজট ছিল না। সরেজমিন বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিমপাড় মহাসড়কের কড্ডার মোড়, ঝাঐল ওভার ব্রিজ ও নলকা, হাটিকুমরুল মোড়, চান্দাইকোনা এলাকায় গিয়ে কোনো যানজট পাওয়া যায়নি। গার্মেন্ট ফেরত রাহেলা খাতুন, কল্পনা বেগম জানান, সকাল ৯টায় ঢাকা থেকে গাড়িতে চড়েছেন। মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জে পৌঁছেছেন। বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩০ হাজার ২৫১টি যানবাহন পারাপার হয়েছে।

বগুড়া : বগুড়া শহরের চারটি আন্ডারপাস (চারমাথা, বারপুর, মহাস্থান ও মোকামতলা) খুলে দেওয়ায় উত্তরের ঈদ যাত্রীরা দ্রুততার সঙ্গে ফিরতে পারছেন ঘরে। সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে বগুড়া হয়ে রংপুর পর্যন্ত নির্মাণাধীন ফোর লেন সড়কের বিভিন্ন জনবহুল মোড়ে ওভারপাস নির্মাণ করাতেও নির্বিঘ্ন হয়েছে যান চলাচল। বগুড়া জেলা বাস মিনিবাস ও কোচ পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম জানান, এবার ঈদে যানজট ছাড়াই বগুড়া-রংপুর মহাসড়ক দিয়ে যাত্রীরা যাতায়াত করতে পারছে। যানবাহনগুলোও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে। পরিবহনকর্মীরা পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ পাচ্ছে। বগুড়া সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান জানান, ঈদে ঘরমুখো মানুষ যাতে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে সেজন্য আন্ডারপাসগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। এবার উত্তরের যাত্রীরা বগুড়ায় কে কোনো দুর্ভোগে পড়বে না।

কুমিল্লা : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ির চাপ বাড়লেও যানজট নেই। স্বস্তিতে বাড়ি ফিরছেন যাত্রীরা। ঈদ উপলক্ষে মহাসড়কের সংস্কার কাজ বন্ধ রেখেছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর। ঢাকা থেকে কুমিল্লায় আসা কামাল উদ্দিন জানান, এবার ঢাকা থেকে ফিরতে কোনো যানজটে পড়িনি। মাত্র দেড় ঘণ্টায় বাস আমাকে পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডে নামিয়ে দিয়েছে। নুর আলী নামের এক যাত্রী জানান, একসঙ্গে ছুটি শুরু হলে মানুষের কষ্ট বাড়ে। এ বছর প্রতিষ্ঠানগুলো ধাপেধাপে ছুটি দেওয়ায় ভোগান্তি কমেছে। এদিকে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের বাগমারা বাজার ও লাকসাম বাইপাসে থেমে যানজট সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা রিজিয়নের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত যানবাহন ও হতাহতদের দ্রুত হাসপাতালে প্রেরণের জন্য পাঁচটি রেকার ও পর্যাপ্ত সংখ্যক অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া পণ্যবাহী এবং যাত্রীবাহী কোনো যানবাহন না থামাতে ও মহাসড়কে চেকপোস্ট না বসাতে হাইওয়ে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

মুন্সীগঞ্জ : পদ্মা সেতু হয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরছে দক্ষিণবঙ্গের মানুষ। নেই কোনো যানজট। টোলপ্লাজায় মাঝেমধ্যে কিছুটা যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে নয় মাস পর গতকাল থেকে স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে আবারো মোটরসাইকেল চলাচল শুরু হয়েছে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার মোটরসাইকেল পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটে গেছে। এদিকে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর বৈচিত্র্য কবরস্থান এলাকায় গতকাল সকাল ৯টার দিকে বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৮ জন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর