সোমবার, ১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

সরু হয়ে যাচ্ছে নদনদী

নাব্য সংকটে বন্ধ হচ্ছে রুট

শামীম আহমেদ

সরু হয়ে যাচ্ছে নদনদী

বাঁচানোই যাচ্ছে না দেশের নদনদী। ১৯৬৭ সালের পর ৪৩ বছরে হারিয়ে গেছে ২০ হাজার কিলোমিটারের বেশি নৌপথ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে নৌপথ পুনরুদ্ধারে বিশেষ গুরুত্ব দিলেও দৃশ্যমান অগ্রগতি সামান্যই। একদিকে চলছে ড্রেজিং, অন্যদিকে ভাঙন আর উজানের পলি জমে ভরছে নদী। নদীখেকোদের দখল-দূষণেও মরছে নদী। কমে গেছে নদীগুলোর পানি প্রবাহ। অনেক স্থানে ড্রেজিংয়ের বালু ফোরশোরে ফেলে নদী সরু করে ফেলা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক দখল, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ড্রেজিং, নৌপথ রক্ষায় নামমাত্র বাজেট বরাদ্দ, আন্তসীমান্ত নদীগুলো থেকে পানির ন্যায্য হিস্সা না পাওয়া ও একক কোনো প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব নিয়ে নদী নিয়ে কাজ না করায় নদীগুলো বাঁচানো যাচ্ছে না। আর নদী মরলে দেশের কৃষি ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে। ভয়াবহ খরার মুখে পড়বে দেশ। ১২২ কিলোমিটার খরস্রোতা করতোয়া নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন পুন্ড্রনগরী। পুন্ড্র সভ্যতার সঙ্গে এখন ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিতে চলেছে করতোয়া নদীও। নদীটির ৪০ কিলোমিটারই এখন মরা নদী। বাকি অংশ কোনো রকমে টিকে আছে। এক সময় ঢাকা থেকে স্টিমারে চড়ে মানুষ যেত চাঁদপুর, বরিশাল, মোংলা হয়ে খুলনা পর্যন্ত। মোংলায় যে স্থানে স্টিমার ঘাট ছিল, সেখানে এখন গড়ে উঠেছে থানা, ঈদগাহ, খেলার মাঠ, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ২০ বছরে নদীর প্রস্থ কমেছে অর্ধেকের বেশি। রাজশাহীর তালাইমারী এলাকায় ছিল খরস্রোতা স্বরমঙ্গলা নদীর উৎসমুখ। কথিত আছে, স্বরমঙ্গলা নদীপথে ধনপতি সওদাগর নামের এক বড় ব্যবসায়ীর ছেলের বরযাত্রী নিয়ে যাচ্ছিলেন। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) এলাকায় নৌকাডুবিতে ধনপতির সলিল সমাধি হয়। সেই থেকে রুয়েট সংলগ্ন অংশটি নাওডোবা নামে পরিচিত। বর্তমানে শুধু প্রবাহের চিহ্ন ছাড়া নদী বলে কিছু নেই। একইভাবে ডুবোচরের কারণে খরস্রোতা পদ্মা ও যমুনার মিলনস্থল গোয়ালন্দে ফেরি চলছে ২ কিলোমিটার ঘুরে। এদিকে প্রতি বছর বর্ষা যেতেই সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, চৌহালী ও এনায়েতপুরে যমুনা নদীতে জেগে উঠছে অসংখ্য ডুবোচর। সেই চরে আটকে যাচ্ছে পণ্যবাহী জাহাজ-কার্গো। নাব্য হ্রাস পাওয়ায় বর্ষায় ৭ কিলোমিটার প্রস্থের যমুনার এপার-ওপারের দূরত্ব এখন আড়াই কিলোমিটার। নদীর বুকে আবাদ হচ্ছে ফসল। সারা বছর ড্রেজিং চললেও শুষ্ক মৌসুম এলেই পদ্মায় মাঝিকান্দি-শিমুলিয়া নৌরুটে ফেরি চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। বিশাল পদ্মার বুকে এখন বড় বড় চর। সেখানে ঘরবাড়ি তুলে বসবাস করছে মানুষ। দেশের অধিকাংশ নদ-নদীরই এমন বেহাল দশা। বন্ধ হয়ে গেছে অসংখ্য নৌপথ। নাব্য সংকটের কারণে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) গত মার্চের নদী বিজ্ঞপ্তিতে ২৩টি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথের মধ্যে ১৫টি পথে শুধু দিনের বেলায় নৌযান চলাচল করতে বলা হয়। এ ছাড়া দাউদকান্দি-সোনামুড়া নৌপথটি বন্ধ রাখা হয়। চলাচলকারী জাহাজগুলোর সর্বোচ্চ গভীরতাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।

গবেষণা অনুযায়ী, এক টন পণ্য প্রতি কিলোমিটার পরিবহনে সড়কপথে ব্যয় হয় সাড়ে ৪ টাকা, রেলপথে আড়াই টাকা ও নৌপথে মাত্র ৯৯ পয়সা। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে সড়কের পরিবর্তে নৌপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করলে বাঁচবে ৫৮.৫ মিলিয়ন লিটার ডিজেল। পাশাপাশি ১ লাখ ৫৫ হাজার টন কম কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন হবে। পণ্য পরিবহন ব্যয় এক-পঞ্চমাংশে নেমে আসবে। এসব বিবেচনায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই সারা দেশের নদী উদ্ধারে পদক্ষেপ নেয়। ঢাকার চার নদী উদ্ধারসহ ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননে নেওয়া হয় বড় বড় প্রকল্প। তবে সরকারের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে এলেও লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক নৌপথও চালু হয়নি। গত ১০ বছরে নৌপথ বেড়েছে মাত্র ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর প্রধান প্রকৌশলী (ড্রেজিং) রকিবুল ইসলাম তালুকদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১০ সালের আগে নৌপথ ৩ হাজার ২০০ কিলোমিটারে চলে এসেছিল। এখন শুষ্ক মৌসুমে ৫ হাজার কিলোমিটার নৌপথ সচল থাকছে। এটা গত ১০ বছরের অর্জন। প্রতিদিনই পলি জমছে, প্রতিদিন ড্রেজিং করতে হচ্ছে। এ জন্য সময় লাগছে। আগের ১১টি নদীবন্দর বাড়িয়ে ৩৬টি করা হয়েছে। নদীবন্দর হলে সেখানকার নৌপথ সবসময় চালু থাকবে। ১০০টি ইকোনমিক জোনের অধিকাংশ নদীকেন্দ্রিক। এ জন্যও ওই অঞ্চলের নদীগুলো সচল হবে। প্রসঙ্গত, ১৯৬২-৬৭ পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসের সংস্থা নেডকোর সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে নদীপথের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। আর নামমাত্র খরচে দেশের বেশির ভাগ পণ্য পরিবহন হতো এসব নৌপথ দিয়েই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর