সোমবার, ১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা
মে দিবস আজ

বৈষম্যের শিকার শ্রমজীবী মানুষ

► ৭৭ লাখ কৃষি শ্রমিকের নেই নির্ধারিত মজুরি ► আরও নানা খাতে কর্মজীবীরা বঞ্চনায় ► পুরুষের চেয়ে কম মজুরি নারীর

জিন্নাতুন নূর

বৈষম্যের শিকার শ্রমজীবী মানুষ

ছবি : জয়ীতা রায়

বাংলাদেশের বিভিন্ন পেশাভিত্তিক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ড। সে হিসেবে সরকার ৪৪টি খাত নির্ধারণ করে এসব খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু এখনো দেশের সবচেয়ে বড় খাত কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য আলাদা কোনো মজুরি নির্ধারণ করা হয়নি। গৃহশ্রমেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শ্রমিক কর্মরত থাকার পর এই শ্রমিকদের জন্য নেই নির্ধারিত মজুরি। আবার নারী শ্রমিকরা বরাবরই পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরি পান। অভিযোগ আছে, পোশাক খাত ছাড়া নিয়মিত ভিত্তিতে অন্য খাতগুলোতে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ। এর ফলে  দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে শ্রমিকদের জীবনধারণ করা হয়ে পড়েছে অতিকষ্টের। এ অবস্থায় আজ সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন মহান মে দিবস পালিত হবে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিম্ন মজুরি বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মজুরি নির্ধারণে বেশ কয়েকটি খাতের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু বিভিন্ন খাতভিত্তিক শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে।

প্রসঙ্গত, নিম্নতম মজুরি বোর্ডের নিয়মিতভাবে মজুরি পর্যালোচনা করে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা। বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর পর নিম্নতম মজুরি পুনর্বিবেচনা করার বিধানও রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কাজটি উপেক্ষিত হচ্ছে। শ্রম সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৬ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন খাতে কাজ করে। কিন্তু দেখা গেছে, মজুরি বোর্ডের নির্ধারিত খাতগুলোর মধ্যে কোনো খাতে মজুরি আড়াই হাজার টাকা, আবার কোথাও সর্বোচ্চ ১৭ হাজার ৯০০ টাকা। শ্রমিকদের অভিযোগ, অনেক সময় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয় না। এর মধ্যে সিরামিকস ও সিমেন্ট কারখানাকে এই বোর্ডে নতুন খাত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও এ দুটি খাতের মজুরি এখনো নির্ধারিত হয়নি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে কৃষি শ্রমিক আছেন ৭৭ লাখ। বিবিএসের কৃষি ও পল্লী পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে একজন কৃষি শ্রমিক গড়ে দৈনিক ৩৮৬ টাকা মজুরি পান।  আবার তারা প্রতিদিন যে কাজ পান, তাও নয়। দেশের সব জেলার পল্লী এলাকার ৫৭ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এই টাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুই বেলা শাক-সবজি দিয়ে খেয়ে পরে থাকাও এখন কষ্টের। নিম্নতম মজুরি বোর্ড কর্তৃপক্ষও কৃষি শ্রমিকদের বোর্ডের আওতায় আনবেন না। ফলে বরাবরের মতোই বাজারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে কৃষি খাতে মজুরি নির্ধারিত হবে।

শ্রমিক সংগঠনগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, দেশের পরিবহন খাতে মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। ২০২০ সালের ২১ জুলাই পরিবহন শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ হিসাবে একজন চালকের বেতন সর্বোচ্চ ২০ হাজার ২০০ থেকে সর্বনিম্ন ১৪ হাজার ৪০০। চালকের সহকারীর বেতন ১০ হাজার ৭৫০ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে এই শ্রমিকদের বেতন বাড়ার কথা। কিন্তু রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসচালক ও তাদের সহকারীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, তারা কেউ নির্ধারিত বেতন পান না। যত ট্রিপ, তত টাকা- এই চুক্তিতে তারা বাস চালান। মালিকের জমা, লাইন খরচ, জ্বালানি খরচ ও নিজেদের খাওয়ার খরচ বাদ দেওয়ার পর চালক ও সহকারী নিজেদের আয় বুঝে নেন। নির্দিষ্ট মজুরি না থাকায় বেশি ট্রিপের আশায় চালকরা বেপরোয়াভাবে বাস চালান। 

কপাল বদলায়নি গৃহশ্রমের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদেরও। এখনো চুক্তি ভিত্তিতে দেশের গৃহশ্রমিকরা কাজ করছেন। রাজধানীর রূপনগর আবাসিক এলাকার এক গৃহকর্মী নাজমা আক্তার ঢাকায় ১৫ বছর ধরে গৃহশ্রমে নিযুক্ত। তিনি জানান, মোট চারটি বাসায় তিনটি করে কাজ করছেন। প্রতি কাজে ৭০০ টাকা করে এক বাসায় ২১০০ টাকা পান। মাস শেষে তার মোট আয় ৮ হাজার ৪০০ টাকা। এই টাকায় তার দুই ছেলে এবং অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে এক রুমের একটি বাসার রুম ভাড়া ও মাসের খাওয়ার খরচ মিটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। মাস শেষে প্রায়ই নাজমাকে পরিচিতদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সংসার চালাতে হয়।

 

নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সর্বশেষ প্রকাশিত বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের মজুরি তালিকা থেকে জানা গেছে, টাইপ ফাউন্ড্রি শিল্পে শ্রমিকের মজুরি- সর্বশেষ ১৯৮৩ সালে মজুরি মাত্র ৫২১ টাকা নির্ধারিত হয়। পেট্রল পাম্প খাতের শ্রমিকের মজুরি সর্বশেষ ১৯৮৭ সালে মোট ৭৯২ টাকা নির্ধারিত হয়। এর মধ্যে পেট্রল পাম্পের শ্রমিকদের মোট মজুরির মধ্যে মূল বেতন ৫৬০ টাকা। বাড়ি ভাড়া ১১২ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ১০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ২০ টাকা ধরা হয়।

বর্তমান সময়ে এই বেতন কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যদিও দীর্ঘ সময় ধরে পেট্রল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি সমন্বয় করা হয়নি, তবে মাসে তারা এখন আট থেকে ১০ হাজার করে টাকা পাচ্ছেন। নিম্নতম মজুরি বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, টাইপ ফাউন্ড্রি খাত দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শিগগিরই একে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিলুপ্ত ঘোষণা করবে। অন্যদিকে পেট্রল পাম্প খাতের মজুরি নির্ধারণে মালিক প্রতিনিধিদের বোর্ডে আলোচনার জন্য বলা হলেও তারা এ ব্যাপারে আগ্রহী নন। আবার বোর্ডের তালিকা অনুযায়ী ৪৪টি খাতের মধ্যে মাত্র ৯টি খাতের মজুরি ১০ হাজার টাকার ওপরে।

দীর্ঘ আন্দোলনের পরও চা শ্রমিকদের মানবেতর জীবনের উন্নতি হয়নি। গত বছর দীর্ঘ আন্দোলনের পর অবশেষে চা শ্রমিকদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। এর আগে ১২০ টাকা মজুরিতে তারা কাজ করতেন। যদিও শ্রমিকদের দাবি ছিল দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার। দেশের ১৬৭টি চা বাগানে শ্রমিক প্রায় ১ লাখ। একজন শ্রমিকের মজুরির ওপর কমপক্ষে পাঁচজনের ভরণপোষণ নির্ভর করে।

এ ছাড়া নারী শ্রমিকরা বরাবরই পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় কম মজুরি পেয়ে আসছেন। বিশেষ করে দিনমজুর ও  নির্মাণকাজে জড়িত শ্রমিকরা এ ক্ষেত্রে বেশি বঞ্চিত। পুরুষের সমান কাজ করেও তারা কম মজুরি পান। একজন পুরুষ দিনমজুর যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা পান, সেখানে একজন নারী শ্রমিক পান ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকা।

নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা করা হয়েছে। গৃহশ্রমকে খাতে পরিণত করার জন্য আমরা মন্ত্রণালয়ে বলেছি। এর বাইরে জাতীয় মজুরি নীতি নিয়েও কাজ চলছে। এটি বাস্তবায়িত হলে সব খাতের জন্য সর্বনিম্ন মজুরি চলে আসবে। গৃহকর্মীদের জন্য মজুরি বোর্ড গঠন করার জন্য মন্ত্রণালয়ে এরই মধ্যে চিঠি দিয়েছি। তবে কৃষিখাতকে মজুরি বোর্ডের আওতায় আনা হবে না। যখনই কোনো খাতের মজুরি নির্ধারণের পাঁচ বছর শেষ হয়, আমরা সেই খাতের নাম মন্ত্রণালয়ে পাঠাই তাদের প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য। মন্ত্রণালয় তা শ্রম অধিদফতরে পাঠায়। শ্রম অধিদফতর থেকে ট্রেড ইউনিয়নগুলোতে চিঠি দিয়ে প্রতিনিধি চাওয়া হয়। এরপর মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি পাওয়ার সাপেক্ষে বোর্ড গঠিত হয়। কিন্তু অনেক ইউনিয়নে চিঠি পাঠালেও তারা প্রতিনিধি পাঠান না। এর মধ্যে সল্ট ক্রাশিং, ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ ও সোপ অ্যান্ড কসমেটিক্স-এর প্রতিনিধিদের অনেকে পদত্যাগ করেছে। আবারও আমরা প্রতিনিধি চেয়েছি। এসব খাতের মজুরি নির্ধারণের কাজ এখন চলছে।

সর্বশেষ খবর