মঙ্গলবার, ১৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

সংকটেও মুনাফা বেড়েছে ইসলামী ব্যাংকগুলোর

নিজস্ব প্রতিবেদক

গ্রাহকরা বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করায় আমানত কমে তারল্য সংকটে পড়লেও ২০২২ সালে দেশের বেশির ভাগ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে। বিগত সময়ে অতিরিক্ত তারল্য থাকলেও কথিত ঋণ কেলেঙ্কারির সংবাদ প্রকাশের পর আমানতকারীরা টাকা তুলে নেওয়ায় গত বছর নগদ অর্থের ঘাটতিতে পড়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো। এমন পরিস্থিতিতে গত বছর ডিসেম্বরে কয়েকটি ব্যাংককে তহবিল দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ইসলামিক বন্ড সুকুক এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ থেকে আয় বৃদ্ধির কারণে গত বছর সম্মিলিতভাবে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মুনাফা ২৯ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা হয়েছে। কিন্তু নিট বিনিয়োগ থেকে আয় (ঋণ ও অগ্রিম) তুলনামূলকভাবে কমেছে। আর এককভাবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মুনাফা বেড়েছে ২৮ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কিছু শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক করপোরেট সুশাসন সম্পর্কিত বিভিন্ন কারণে আমানত সংগ্রহে সাময়িক সমস্যায় পড়েছিল। তখন তারা সুকুক বন্ডে বিনিয়োগ, কমিশন এবং ফি সংক্রান্ত সেবাগুলোতে মনোযোগ দেওয়ায় মুনাফা বেড়েছে। যখন ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহ করতে সমস্যায় পড়ে, তখন তারা ঋণ বিতরণ ও মুনাফা করতে উচ্চ কমিশন এবং ফি পাওয়ার জন্য সিকিউরিটিজ এবং সেবায় বিনিয়োগে মনোযোগ বাড়ায়।

২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানত ২ দশমিক ৭১ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৯ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকায়। যা সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ৪ লাখ ২১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। আট বছর পর প্রথমবারের মতো ইসলামী ব্যাংকগুলোর আমানতের পতন হয় গত বছর। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইসলামিক ব্যাংকিং সংক্রান্ত অক্টোবর-ডিসেম্বর ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুসারে, তিন মাসে ব্যাংকগুলো ১১ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা আমানত হারিয়েছে। তৃতীয় প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) থেকে চতুর্থ প্রান্তিকে ১১ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা আমানত কমে যাওয়ায় পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ডিসেম্বরে সম্মিলিতভাবে ৩ লাখ ৭৯ হাজার ৯৫১ কোটি টাকার আমানত ছিল, যা আগের প্রান্তিকের চেয়ে ৩ শতাংশ কম। সেপ্টেম্বর শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৯১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো ভালো কাজ করেছে। তাই তারা সংকট থেকে পুনরুদ্ধার হতে সক্ষম হয়েছে এবং ভালো মুনাফা করেছে। এটি একটি ভালো লক্ষণ যে, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো একটি কঠিন সময়ে বেশি মুনাফা করেছে।

বাংলাদেশে ১০টি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক রয়েছে : ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল), আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। তাদের মধ্যে আল-আরাফাহ এখনো ২০২২-এর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। যে নয়টি ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তার মধ্যে সাতটি বেশি মুনাফা করেছে, দুটি কম আয়ের কথা জানিয়েছে এবং একটি লোকসানে রয়েছে। পুঁজিবাজার থেকে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত আয় গত বছর ৫৭ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৫৪ কোটি টাকা হয়েছে যেখানে কমিশন এবং ফি থেকে আয় ৪৬ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা হয়েছে। নিট বিনিয়োগ আয় ৭ শতাংশ বেড়ে ৮ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা হয়েছে। দেশের বৃহত্তম শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড সর্বোচ্চ মুনাফা করেছে। ব্যাংকটির মুনাফা ২৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬১৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মুনাফা ছিল ৪৮০ কোটি টাকা। যা ২০২০ সালে ছিল ৪৭৯ কোটি টাকা এবং ২০১৯ সালে ৫৪৮ কোটি টাকা। এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত বছর আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল। গ্রাহক শুভাকাক্সক্ষী এবং শেয়ারহোল্ডাররা আমাদের ব্যাংকের প্রতি আস্থা রেখেছেন। ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকরা যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করেছেন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর মুনাফায় সুকুক বন্ডের অবদানের কথা উল্লেখ করে মুনিরুল মওলা বলেন, শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগের বৈচিত্র্যের অভাব ছিল। সুকুক ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগের পোর্টফোলিওকে বৈচিত্র্যময় করতে সাহায্য করেছে। জানা গেছে, এক্সিম ব্যাংকের মুনাফা ৭৩ শতাংশ বেড়ে ৩৭২ কোটি টাকা এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের মুনাফা ৭৩ শতাংশ বেড়ে ১৫১ কোটি টাকা হয়েছে। এ ছাড়া এসআইবিএলের মুনাফা ৪০ শতাংশ বেড়ে ২৪৬ কোটি টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের মুনাফা ৪৫ শতাংশ বেড়ে ১১২ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা ৩৭ শতাংশ বেড়ে ৩৫৮ কোটি টাকা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ইসলামিক ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জনগণের চাহিদা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তায় দেশে ইসলামী ব্যাংকিং শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি করছে। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষে, সামগ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মোট আমানতের ২৫ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ২৯ দশমিক ২০ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করেছে ইসলামী ব্যাংকগুলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে সারা দেশে ইসলামী ব্যাংকের শাখার সংখ্যা (প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকের ইসলামী শাখাসহ) দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২১৭টিতে। যা এক বছর আগেও ছিল ২ হাজার ৮০টি। এসব ব্যাংকে গত ডিসেম্বরের শেষে নিয়োগকৃত জনবলের সংখ্যা ৪৯ হাজার ৮৫১ জন। ১১টি প্রচলিত ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং শাখা রয়েছে এবং ১৪টি ব্যাংকের ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং উইন্ডো রয়েছে।

সর্বশেষ খবর