বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

এখনো গোলকধাঁধায় হারিছ

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

এখনো গোলকধাঁধায় হারিছ

রাজনীতিতে ছিলেন রহস্যপুরুষ। মাঠের রাজনীতিতে আলোচিত না হলেও নিয়ন্ত্রণ করতেন চারদলীয় জোট সরকার। ছিলেন ‘হাওয়া ভবনের’ প্রভাবশালী ব্যক্তি। তৎকালীন তার দাপটে তটস্থ থাকতে হতো বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদেরও। ওয়ান-ইলেভেনের পর ‘হাওয়া’ হয়ে যাওয়া হাওয়া ভবনের দাপুটে হারিছ চৌধুরীকে নিয়ে ছিল নানা রহস্য। কখনো ভারতে, আবার কখনো যুক্তরাজ্য, ইরানসহ বিভিন্ন দেশে তার অবস্থানের কথা আলোচিত হয় গণমাধ্যমে। আলোচিত হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুও যেন এখন গোলকধাঁধায় আটকা। পরিবারের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করা হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খাতায় এখনো তিনি পলাতক। পরিবারের দাবিকৃত কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে ডিএনএ টেস্ট না করায় আইনিভাবে তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি। ইন্টারপোলের রেড নোটিসেও ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হিসেবে রয়েছে হারিছ চৌধুরীর নাম। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে দুর্দ-প্রতাপশালী আবুল হারিছ চৌধুরী ওয়ান-ইলেভেনের পর আত্মগোপনে যান। তার ঠিক আগে তিনি তার গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দর্পনগরে অবস্থান করছিলেন। সর্বশেষ সেখানেই তাকে দেখা গিয়েছিল। এরপর তাকে নিয়ে বাড়তে থাকে রহস্যের ডালপালা। হারিছ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজনদের ধারণা, ওই সময় তিনি জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ভারতের করিমগঞ্জে তার নানাবাড়িতে তিনি পালিয়ে যান। এরপর কখনো শোনা যায়, তিনি মেয়ের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে আবার কখনো ইরানে তার ভাইয়ের কাছে আছেন। নানাবাড়ি অবস্থানকালে তিনি ভারতীয় পাসপোর্ট করে তাদের কাছে বেড়াতে গেছেন এমন গুঞ্জনও ওঠে নানা সময়। কিন্তু হারিছ চৌধুরীকে স্বচক্ষে কোথাও দেখা গেছে এমনটা বলতে পারেননি কেউ। ২০২১ সালের শেষ দিকে হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী গণমাধ্যমকে তার মৃত্যু সংবাদ জানান। ওই সময় আশিক চৌধুরী জানান, যুক্তরাজ্যে হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন। হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু সংবাদটি দেশজুড়ে আলোচিত হয়। কিন্তু এরপর হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী চাচা আশিক চৌধুরীর দেওয়া অসত্য দাবি করে গণমাধ্যমকে জানান, তার বাবা দেশেই ছিলেন। ঢাকার পান্থপথে একটি বাসায় থাকতেন। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি ঢাকার দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।

হারিছ চৌধুরীর মেয়ের বক্তব্যের সূত্র ধরে ওই সময় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয় ঢাকার সাভারের একটি মাদরাসায় তাকে দাফন করা হয়। জামিয়া খাতামুন্নাবিয়্যীন নামক মাদরাসায় ৫ লাখ টাকা অনুদান দিয়ে ওই মাদরাসার কবরস্থানে দাফন করা হয় হারিছ চৌধুরীকে। দাফনের ব্যাপারে মাদরাসার সঙ্গে যোগাযোগ করেন হারিছ চৌধুরীর মেয়ে। তবে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জানতেন না যাকে ওই কবরস্থানে দাফন করা হচ্ছে তিনি হারিছ চৌধুরী। হারিছ চৌধুরী পান্থপথের যে বাসায় থাকতেন সেখানে তিনি মাহমুদুর রহমান নামে পরিচিত ছিলেন। এই নামে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টও তৈরি করেন। লম্বা সাদা দাড়ি রেখে তিনি নিজের চেহারায় পরিবর্তন আনায় তাকে কেউ চিনতে পারত না। বাসার কেয়ারটেকার ও অন্য বাসিন্দারা জানতেন মাহমুদুর রহমান নামের ওই ব্যক্তি একজন সাবেক অধ্যাপক। হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা বাবার মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর আত্মীয়স্বজন ও দলীয় শুভাকাক্সক্ষীদের তোপের মুখে পড়েন আশিক চৌধুরী। মৃত্যুর পর আশিক চৌধুরী বিষয়টি গোপন রাখতে এবং বাড়িতে লাশ আনতে বাধা দেন বলেও অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে হারিছ চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে আশিকের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। সেই দ্বন্দ্ব এখন আরও প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশিক চৌধুরী প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে হারিছ চৌধুরীর পরিবার ও মেয়ে নিয়ে কটূক্তি করেন। পরে নানা অভিযোগে হারিছের পরিবারের পক্ষ থেকে আশিকের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগও করা হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর দাবি করা হলেও এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর চাউর হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রয়োজনে কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে ডিএনএ টেস্ট করার কথা জানানো হয়েছিল। হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হতে প্রয়োজনে ডিএনএ টেস্ট করা হলে পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি থাকবে না বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর চিঠি পাঠিয়েছিলেন সামিরা। কিন্তু গেল দেড় বছরেও ডিএনএ টেস্টের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে, এখনো প্রমাণিত হয়নি মৃত মাহমুদুর রহমান ও হারিছ চৌধুরী একই ব্যক্তি কি না। যে কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খাতায় হারিছ চৌধুরী এখনো পলাতক। ইন্টারপোলের রেড নোটিসেও ঝুলছে হারিছ চৌধুরীর নাম। ইন্টারপোলের রেড নোটিসে অর্থাৎ মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় যে ৪৭ জনের নাম রয়েছে হারিছ চৌধুরীর নাম সেখানে রয়েছে ১২ নম্বরে। ইন্টারপোলের কাছেও হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর কোনো দালিলিক প্রমাণ না থাকায় তারা নোটিসটি প্রত্যাহার করছে না। প্রসঙ্গত, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম আসামি ছিলেন আবুল হারিছ চৌধুরী। এই মামলায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এস এম কিবরিয়া হত্যা মামলারও আসামি তিনি। ২০১৫ সালে ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করে। ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে হাতেখড়ি হারিছ চৌধুরীর। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যোগ দেন জাগদলে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। বিএনপি গঠনের পর সংগঠনটির সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক হন হারিছ। পরে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতি, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন হারিছ। তবে ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী হন তিনি। আর ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর হারিছ চৌধুরীকে রাজনৈতিক সচিব করেন খালেদা জিয়া।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর