রবিবার, ১১ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

তলানিতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য

♦ বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা ♦ অধিকাংশের সমস্যা হতাশা, অবসাদ, একাকিত্ব ♦ মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার ♦ অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা ♦ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট

জয়শ্রী ভাদুড়ী

তলানিতে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য

‘শেষমেশ একাকিত্বই আমাকে গিলে খেল।’ ৮ জুন হতাশার কথা চিরকুটে লিখে ছাত্রাবাসে নিজ কক্ষে আত্মহত্যা করেন তানভীর ইসলাম। তানভীর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন।

গত ছয় মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) তিনজন এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) দুজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। মানসিক অবসাদ ও পারিবারিক সমস্যার কারণেই তারা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন বলে সুইসাইড নোটে উল্লেখ করেছেন। দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি করেছে। কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে কিংবা কোনো পরীক্ষার ফল খারাপ হলে লোকলজ্জার শঙ্কায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। করোনাভাইরাস মহামারি-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থী, অন্যান্য পেশাজীবী এবং বিভিন্ন বয়সী মানুষের মানসিক সমস্যা, অবসাদ, হতাশা বেড়েছে। শিক্ষাজীবনে দুই বছরের ক্ষতি, স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হওয়া, ইন্টারনেটে আসক্তি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে তলানিতে পৌঁছে দিয়েছে।

দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যায় সহায়তা করতে কাউন্সেলিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। গুটিকয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও তা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সেরকম ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে দেশে প্রায় দেড় লাখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশে বর্তমানে মানসিক রোগের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৩৫০ জন এবং কাউন্সেলিংয়ের জন্য সাইকোলজিস্ট রয়েছেন ৫০০। তাই এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে কার্যত অসম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিশোর-তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বিশ্বজুড়েই বেড়েছে। দেশের তরুণদের মধ্যে হতাশা, অবসাদ থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার প্রবণতাও ঊর্ধ্বমুখী। এর বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম দ্রুত নগরায়ণের ফলে নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে তারা খুব বেশি সচেতন হয়ে পড়ছে। দ্রুত নিজের অবস্থান তৈরি করতে যে ধাপগুলো অনুসরণ করা দরকার, তা সঠিকভাবে করছে না। এর মধ্যে তথাকথিত মোটিভেশন স্পিকারদের ‘সিক্স ডিজিট স্যালারি’র চিৎকার তরুণদের মস্তিষ্কে গেঁথে যাচ্ছে। অনেকেই সে জায়গায় যেতে পারছে না, ফলে খুব দ্রুতই হতাশ হয়ে পড়ছে। ভালো মানুষ হওয়ার চাইতে কিশোর-তরুণদের মধ্যে বড় গাড়ি, বড় বাড়ির স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। এসব চাহিদা তাদের হতাশ করে তুলছে। তিনি আরও বলেন, ‘অভিভাবকরা কিশোর-তরুণ ছেলেমেয়েদের পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। সন্তান প্রতিপালনের পদ্ধতি পরিবর্তন হওয়ায় তাদের মনোজগতেও একটা ছাপ ফেলছে। তরুণরা সামাজিক না হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আসক্তিতে পড়ে যাচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীদের মনোজগতের মৌলিক জায়গাগুলোয় নজর দিতে হবে। সন্তান প্রতিপালনে নজর দিতে হবে। চিন্তাভাবনা থাকতে হবে আদর্শিক মানসিকতার এবং তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলিংয়ের জন্য সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দিতে চাইলে আরও অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ দেশে মানসিক রোগের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৩৫০ জন এবং কাউন্সেলিংয়ের জন্য সাইকোলজিস্ট রয়েছেন ৫০০। দেড় লাখ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তুলনায় এ সংখ্যা খুবই অপ্রতুল।’

গতকাল আঁচল ফাউন্ডেশন ‘শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রভাব : কতটুকু সতর্ক হওয়া জরুরি’ বিষয়ে একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। জরিপের তথ্যে দেখা যায়, জরিপে অংশ নেওয়া ১ হাজর ৭৭৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭২ দশমিক ২ শতাংশ জানিয়েছেন তারা মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। এর মধ্যে ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানান তাদের মানসিক সমস্যার পেছনে ইন্টারনেটের ভূমিকা রয়েছে। ইন্টারনেটকে পুরোপুরি দায়ী মনে করেন ২৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং মোটামুটি দায়ী ভাবেন ৫৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী। সমীক্ষার তথ্যানুসারে, ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেকে অন্যদের তুলনায় খুব সংকীর্ণ, অযোগ্য, ব্যর্থ বা অসুখী মনে করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কার্যক্রম ২১ দশমিক ৭ শতাংশের ভিতর রাতারাতি জনপ্রিয় হওয়ার ইচ্ছা তৈরি করে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা আশঙ্কা তৈরি করছে অভিভাবকদের ভিতর। আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রতিনিধি রায়হান ইসলাম জানান, গত ছয় মাসে রাবির তিনজন এবং রুয়েটের দুজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কবিচ্ছেদের হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেন বাংলা বিভাগের সাবেক ছাত্র ইশতিয়াক মাহমুদ পাঠান। একই বছরের ৮ এপ্রিল ‘জীবনের কাছে হার মেনে গেলাম। আমি আর পারলাম না’ ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দিয়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন চারুকলা অনুষদের ছাত্র সোহাগ খন্দকার। ১০ মে ‘চোরাবালির মতো ডিপ্রেশন, মুক্তির পথ নেই, গ্রাস করে নিচ্ছে জীবন, মেনে নিতে পারছি না’ এমন সুইসাইড নোট লিখে ময়মনসিংহের নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাদিয়া তাবাসসুম। ২৬ সেপ্টেম্বর বিয়ের তিন মাস পরই আত্মহত্যা করেন রাবির অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছন্দা রায়। ২০ ডিসেম্বর হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র মৃত্যুঞ্জয়ী সেন ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগে আত্মহত্যা করেন। এ বছরের ২০ জানুয়ারি আত্মহত্যা করেন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সামেয়া আবারী। ১৭ ও ২০ মে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সামিউর রহমান ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তানভীর আহমেদ আত্মহত্যা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। গত ছয় বছরে এ কেন্দ্রে সেবা নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থী। এর ৮০ শতাংশই শিক্ষার্থী। করোনা-পরবর্তী সময়ে এ সেবা প্রদানের হার এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর আত্মহননের উচ্চঝুঁকিতে থাকা প্রায় ২১২ জন সেবা নিয়েছেন। এ ছাড়া হতাশায় আক্রান্ত হয়ে সেবা নিয়েছেন ২০০ জন। রাবি মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক মনোবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল হাসান সুফি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ কেন্দ্রে প্রতিনিয়তই শিক্ষার্থী বিভিন্ন মানসিক সমস্যা নিয়ে আসছেন। এতে মানসিক অবসাদ, দুশ্চিন্তা ও হতাশাগ্রস্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। আত্মহননের প্রবণতা আছে এমন রোগীও অনেক। বিভিন্ন কারণে তারা এ সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে অধিক প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য না হওয়ায় হতাশা, ভারসাম্যপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত না হওয়া এবং মাত্রাতিরিক্ত প্রযুক্তি আসক্তি এ সমস্যাগুলোকে আরও জটিল করছে।’ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৭ বছর পর গত বছর স্বল্পপরিসরে উদ্বোধন করা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সেলিং সেন্টার। কিন্তু কাক্সিক্ষত সেবা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা। কাউন্সেলিং সেন্টারে সেবা দেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যয়নরত যে কোনো দুজন শিক্ষার্থী। কোনো শিক্ষক কিংবা বিশেষজ্ঞ কেউ আসেন না এখানে। তাদের দিয়েই চালানো হচ্ছে এ সেন্টার।

কাউন্সেলিং সেন্টার পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থীকে সেবা দিয়েছি। মনোবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ৩০ জন শিক্ষার্থী এখানে নিয়মিত কাজ করছে। এখানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী হতাশা, চাকরির পরীক্ষার ভাইভা বোর্ডে ফেল করে, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, একাকিত্ব এবং প্রেমসংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আসেন।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) গত এক দশকে ১৫ জনের মতো শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এ বছর এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তারা হলেন অমিত কুমার বিশ্বাস, হাবিবুর রহমান ও সিয়াম মো. আরাফাত। তাদের আত্মহত্যার কারণ ছিল চাকরি না পেয়ে হতাশা ও মানসিক অসুস্থতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ হাজার শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে রয়েছেন দুজন সাইকোলজিস্ট ও একজন কাউন্সেলিং অফিসার। জাবি চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) শামছুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া ভালো মানের সাইকোলজিস্টের প্রয়োজন আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক (মনোবিজ্ঞান) ইফরাত জাহান বলেন, নিয়মিত কাউন্সেলিং ও সচেতনতার জন্য অনলাইনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি। শিক্ষার্থীদের তুলনায় লোকবল কম। কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট নেই।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সুপ্রিয় অধিকারী বলেন, ‘আমার মেয়ে সারাক্ষণ ফোন নিয়ে বসে থাকে। পড়াশোনায় কোনো মনোযোগ নেই। হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলে দরজা লাগিয়ে দিয়ে কান্নাকাটি করে। অভিমানে ছেলেমেয়েদের আত্মহত্যার সংবাদ দেখে বুকটা কেঁপে ওঠে। কিন্তু মেয়ের আচরণ কোনোভাবেই স্বাভাবিক, সামাজিক করতে পারছি না। তাই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

সর্বশেষ খবর