রবিবার, ১১ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

চিরকালের আড়ালে

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

আন্দোলন-সংগ্রামে যিনি মুখর ছিলেন, বিদ্রোহী চেতনায় ছিলেন উদ্দীপ্ত বিস্ফোরক, মিছিলে-সেøাগানে ছিলেন জ্বালানি। অথচ সবকিছু তিনি করেছেন আড়ালে, গোপনে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। খ্যাতির মোহ, জনপ্রিয়তার মোহ, পদ-পদবির মোহ, মন্ত্রিত্বের মোহ, অর্থ-বিত্তের মোহ কোনোদিনই তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তার একমাত্র আরাধ্য ছিল স্বাধীনতা। তিনি হলেন, স্বাধীনতার সফল স্বপ্নদ্রষ্টা সিরাজুল আলম খান। প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে আড়ালে থাকা, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ৯ জুন, ২০২৩ যন্ত্রণাদায়ক অসুস্থতাকে পরিত্যাগ করে চিরদিনের জন্য আড়াল হয়ে গেলেন। জাতি তাকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বেদনাদায়ক অনুভূতিতে বিদায় দিয়েছে। সিরাজুল আলম খানের মতো স্বাধীনতা অন্তঃপ্রাণ মানুষ বিরল। স্বাধীনতার প্রশ্নে ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে, সব বাধাকে অতিক্রম করে, দুঃসাধ্যকে জয় করে স্বাধীনতার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়েছেন। আড়াল থেকে সংগ্রামের পটভূমি তৈরি করেছেন, সংগঠিত করেছেন গণঅভ্যুত্থান। সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার অগ্রদূত, অসাধারণ মানবতাবাদী রাজনৈতিক দার্শনিক। আমাদের কালের মর্যাদাপূর্ণ নায়ক, মহৎ মানুষ। যিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত স্বাধীনতা ও মানুষের মুক্তি সংগ্রামের স্বপ্ন বপন করেছেন। স্বাধীনতার পতাকা তৈরি ও উত্তোলন, দেশের নামকরণ, জাতীয় সংগীত নির্ধারণ, বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিনায়ক ঘোষণাসহ স্বাধীনতার ইশতেহার প্রণয়ন এবং ইশতেহার পাঠের মধ্য দিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলার ক্ষেত্রে কী দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তা অবশ্যই ইতিহাসের গবেষণার বিষয় হয়ে থাকবে। সিরাজুল আলম খান অনন্য বাঙালি। বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সফল রূপকার তিনি। বঙ্গবন্ধু কাল্ট সৃষ্টিতে সর্বপ্রথম সর্বাগ্রে যার নাম উচ্চারিত হবে তিনি হচ্ছেন সিরাজুল আলম খান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সিরাজুল আলম খানের সম্পর্ক-নৈকট্য এবং পারস্পরিক আস্থা ইতিহাসের উপাদান হয়ে থাকবে। তিনি বাঙালি জাতীয়তাভিত্তিক একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছেন, সে স্বপ্ন পূরণে পরিকল্পনা করেছেন, ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করেছেন এবং স্বপ্নের বিস্তার ঘটিয়েছেন। সর্বোপরি জাতিরাষ্ট্র গঠনে সফল হয়েছেন। পরবর্তীতে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে নিরন্তর ছুটে চলেছেন, রাজনীতির যুদ্ধ থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বিরতি নেননি। বঙ্গবন্ধু এবং সিরাজুল আলম খানের যৌথ মেলবন্ধন ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তি অসম্ভব হয়ে পড়ত। ৪০ কোটি বাঙালির মধ্যে তিনিই একমাত্র বাঙালি যিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের দার্শনিক তত্ত্ব ও রূপ অনুসন্ধান করেছেন। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের চিরকালীন স্থপতি। বাঙালির এখন তৃতীয় জাগরণের পর্যায়- এটা সিরাজুল আলম খান চিহ্নিত করেছেন। এ তাৎপর্যময় ঐতিহাসিক কারণে সিরাজুল আলম খান বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রাণপুরুষ হিসেবে ইতিহাসে সুনির্দিষ্ট জায়গা করে নেবেন। ব্যক্তিজীবনে পদ-পদবি ও সম্পদ প্রাপ্তির প্রশ্নকে নিরন্তর উপেক্ষা করে গেছেন। নিশ্চিত সুখের জীবনের হাতছানিকে অবজ্ঞা করে গেছেন। কারও কারও দ্বারা তিনি প্রচ  আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন কিন্তু টুঁ-শব্দটি উচ্চারণ করেননি। আক্ষেপ বা অভিযোগের ঊর্ধ্বে তুলে নিয়ে গেছেন নিজেকে। সমালোচনাকে অজুহাত হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে কারও সঙ্গে বৈরিতা তৈরি করেননি। সবকিছুকে বিবেচনা করেছেন ন্যায়বিচার ও বাস্তবতার নিরিখে। তার চারিত্রিক গঠনের মধ্যে গভীরভাবে গ্রথিত আছে উদার মানসিকতা। হিংসা-বিদ্বেষকে পরিত্যাগ করে ফেলেছেন, এখানেই সিরাজুল আলম খানের অনন্যতা। তিনি একজন অসাধারণ গুণসম্পন্ন মানবিক মানুষ, আত্মপ্রত্যয়ী ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তিনি সুখে-দুঃখে সর্বদাই জীবন্ত, সর্বদাই হালনাগাদ, সর্বদাই নবায়নযোগ্য চিন্তা করেছেন। তার মতো ব্যক্তিত্ব সমাজে বিরল। আমার সৌভাগ্য আমি তার সংস্পর্শ পেয়েছি। তার রাজনৈতিক চেতনার অংশীদার হয়েছি। তাকে দাদা বলে ডাকতাম। রাজনৈতিক জীবনের অনেকেই দাদাকে পরিত্যাগ করেছেন, আ স ম আবদুর রব সহ আমরা অনেকেই রয়ে গেছি তার সঙ্গে। বিনা প্রশ্নে মান্য করেছি তার নৈতিক কর্তৃত্ব। তিনি আমাদের আদর্শ, পথপ্রদর্শক। আমরা তার স্বপ্নের সারথি। সিরাজুল আলম খান বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রর স্বপ্নদ্রষ্টা। অনেক অনেক ব্যক্তি, অনেক অনেক সংগঠন সিরাজুল আলম খানের অবদান, তার গভীরতা, উচ্চতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাকে সম্মান জানানোর জন্য যে যোগ্যতা প্রয়োজন তা অনেকেরই নেই। সিরাজুল আলম খান বেঁচে থাকবেন, স্বাধীনতার স্পর্ধায়, সার্বভৌমত্বের পতাকায় এবং গণমানুষের চেতনায়।

লেখক : গীতিকবি,  [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর