সোমবার, ১২ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

বরিশালে চতুর্মুখী হাড্ডাহাড্ডি লড়াই

কঠোর নিরাপত্তাবলয় ♦ তিন প্রার্থীর শঙ্কা ♦ অনিয়মে ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি প্রশাসনের

রাহাত খান, বরিশাল

বরিশালে চতুর্মুখী হাড্ডাহাড্ডি লড়াই

বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আজ। গতকাল সকালে নগরীর ১২৬টি কেন্দ্রে ইভিএমসহ সব নির্বাচনী সরঞ্জাম প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। সরঞ্জাম নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছে গেছেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা। এদিকে বরিশাল নগরীতে এখনো অনেক বহিরাগত রয়েছে এবং তারা সুষ্ঠু ভোটে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রার্থীদের। তবে নির্বাচন সুষ্ঠু সুন্দর করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার  মো. সাইফুল ইসলাম এবং রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির। এদিকে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সাতজন। এর মধ্যে চার প্রার্থীর হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিয়েছেন স্থানীয় বিশ্লেষকরা।

বরিশাল সিটির ১২৬টি কেন্দ্রে ভোট হবে ইভিএম মেশিনে। প্রতিটি কেন্দ্রের প্রবেশপথে এবং ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল সকালে নগরীর শিল্পকলা একাডেমি থেকে সব কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে ভোটের সরঞ্জাম বুঝিয়ে দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। নগরীর ৬০ নম্বর জিলা স্কুল কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. কফিল উদ্দিন জানান, সারা দিন এবং রাতভর কেন্দ্রে অবস্থান করে আজ সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণ শুরু করবেন তারা। বিরামহীনভাবে ভোট নেওয়া হবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।

এদিকে গতকাল নানামুখী আশঙ্কার কথা বলেছেন বিরোধী প্রার্থীরা। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস সকালে নগরীর অক্সফোর্ড মিশন রোডে তার প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, নগরীতে এখনো প্রচুর বহিরাগত অবস্থান করছে। তারা সুষ্ঠু ভোটে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। বিভিন্ন বস্তিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোটারদের অর্থ দিয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। তিনি সিটি ভোটে ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা করেন। একই ধরনের অভিযোগ করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম এবং সাবেক মেয়রপুত্র স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রূপণ। তারা সব বাধা এবং হুমকি উপেক্ষা করে ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ অস্বীকার করে গতকাল দুপুরে সদর রোডের প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতেই পারে। আমার দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি স্বাভাবিক। চমৎকার পরিবেশ। এখানে কোনো অস্বাভাবিক পরিবেশ দেখতে পাচ্ছি না।’ সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর স্বাধীনতাবিরোধী ছারছিনা পীরের কাছে যাওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, ছারছিনা পীর বঙ্গবন্ধুর মায়ের (প্রার্থীর নানি) আত্মীয়। তিনি বলেন, আত্মীয়তা এক বিষয় এবং রাজনীতি আলাদা বিষয়। তিনি আমাকে দাওয়াত দিয়েছে। আমি যাব, এটাই তো স্বাভাবিক।

প্রার্থীদের নানা অভিযোগের বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন তার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। বহিরাগত এবং ভোটারদের অর্থ দেওয়ার বিষয়ে কোনো প্রার্থীর অভিযোগ পাইনি। সাংবাদিকদের কাছ থেকে অভিযোগ শুনলাম। এখন দেখব কে কোথায় আছে। তিনি ভোটারদের নির্ভয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রভাবমুক্ত এবং সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশে ভোট গ্রহণের যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভোট সুষ্ঠু করতে প্রতিটি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং তিনটি ওয়ার্ডে একজন করে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। নগরীর ১২৬টি কেন্দ্রের মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) ১০৬টি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ২৪ জন সদস্য এবং সাধারণ কেন্দ্রে ১৮ জন সদস্য মোতায়েন থাকবেন। পর্যাপ্ত টহল ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ২ হাজার ৬০৪ পুলিশ, ১ হাজার ৮৩০ আনসার ছাড়াও ১০ প্লাটুন বিজিবি, ১৬ প্লাটুন র‌্যাব এবং কোস্টগার্ডের ৩টি দল নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবে। পুলিশের কোনো সদস্য ভোটকক্ষে ঢুকতে পারবেন না। এবার বরিশাল সিটিতে মোট ভোটার ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৮ জন। এর মধ্যে নারী ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮০৯ জন এবং পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৮৯ জন। নগরীর ১২৬টি কেন্দ্রের ৮৯৪টি বুথে ভোট দেবেন তারা। সিটি নির্বাচনে সাতজন মেয়র প্রার্থী ছাড়াও ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১১৯ জন এবং ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী ৪২ জন।

বিএনপির ভোটের দিকে তাকিয়ে মেয়র প্রার্থীরা : বরিশাল সিটি ভোটে না থেকেও আলোচনায় বিএনপি। বিএনপি নেতারা তাদের নেতা-কর্মীদের ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে তাদের বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে কেন্দ্রে যাবে বা কাউন্সিলর প্রার্থীরা তাদের কেন্দ্রে নিয়ে যাবেন বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিএনপির এই সমর্থক গোষ্ঠীর ভোট যেদিকে যাবে সেদিকে পাল্লা ভারী হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে দলের নির্দেশনা উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ সমর্থক এক কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় নগরীর ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মজনু বেপারীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বরিশাল সিটি নির্বাচনে বিএনপি নেই। তবে তাদের দলের সাবেক ও বর্তমান ১৯ জন নেতা এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় মেয়র পদে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য কামরুল আহসান রূপণ এবং কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আরও ১৮ জনকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। তারপরও থেমে নেই বিএনপি নিয়ে আলোচনা। তাদের অনেক নেতা ওয়ার্ড পর্যায়ে বিভিন্ন কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীর কাছ থেকে বিএনপির অনেক নেতা অর্থ নিয়েছেন বলে শনিবার বরিশাল প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী কামরুল আহসান রূপণ। আবার বিএনপির অনেক নেতা তার সঙ্গে আছেন বলেও তিনি দাবি করেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মো. সাইফুল ইসলাম জানান, বিএনপি তাদের নেতা-কর্মীদের ভোট কেন্দ্রে যেতে বারণ করেছে। কিন্তু তাদের বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে কেন্দ্রে যাবে। তাদের ভোট কার পক্ষে যায় সেটা দেখার বিষয়। বরিশাল মেট্রোপলিটন প্রেস ক্লাবের সভাপতি কাজী আবুল কালাম আজাদ বলেন, নৌকা বিএনপির আজন্ম শত্রু। তাদের ভোটাররা নৌকায় ভোট দিতেই পারে না। আবার ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখায়ও তারা ভোট দেবে বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে বিএনপির সাবেক মেয়রপুত্র স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রূপণ কিংবা জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপসও বিএনপির সমর্থক গোষ্ঠীর ভোট পেতে পারেন। বরিশাল সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, গত কয়েক দিনের প্রচার-প্রচারণায় ভোটারদের মাঝে উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছে। তারা ভোট কেন্দ্রে যেতে আগ্রহী। বিএনপির সমর্থক গোষ্ঠী নৌকায় ভোট দেবে না। সে ক্ষেত্রে তাদের বেশির ভাগ ভোট যেতে পারে ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা মার্কায়। জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রূপণও বিএনপি সমর্থকদের ভোট পেতে পারেন বলে ধারণা করছেন তারা। যদিও আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত নতুন বরিশাল গড়তে সব দলমতের ভোট প্রত্যাশা করেছেন। জাতীয় পার্টির ইকবাল হোসেন তাপস এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমও বিভিন্ন গণসংযোগে বরিশালের উন্নয়নে দলমত নির্বিশেষে সবার ভোট চেয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি থেকে আজীবন বহিষ্কৃত হয়েও বিএনপির সমর্থক গোষ্ঠীর ভোট প্রত্যাশা করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রূপণ।

সর্বশেষ খবর