শিরোনাম
শনিবার, ১৭ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

মামলা ও রায় আতঙ্কে বিএনপি

৫ শতাধিক মামলা শেষ পর্যায়ে, রায়ের অপেক্ষায় ৩ শতাধিক

শফিউল আলম দোলন ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

মামলা ও রায় আতঙ্কে বিএনপি

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আবারও মামলা ও রায় আতঙ্কে পড়েছে বিএনপি। পুরনো, অচল ও স্থগিত মামলা সচল করে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৫ শতাধিক নেতার মামলা শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং ৩ শতাধিক মামলা রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকদের মতে, সরকারের পরিকল্পনার মধ্যে আছে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা ও আটকে রাখা, যাতে  তারা কেউ  নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন। অর্থাৎ বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করে নিজেদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করাটাই সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু এবার আর সরকারের এ ইচ্ছা কখনোই পূরণ হবে না। জনগণ জেগে উঠেছে। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে   বলেন, বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার ব্যাপারে সরকারের এই মহাপরিকল্পনা আগে থেকেই রয়েছে। একটা মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় আদালতের মাধ্যমে ফরমায়েশি রায় ও সাজা দিয়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বন্দি করে রেখেছে। পুরনো, স্থগিত ও অচল মামলাগুলো সচল করে দ্রুত রায় ও সাজা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে সম্প্রতি যে সাজা বহাল রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, সেটি সরকারের এই পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রেরই অংশ। কিন্তু এতে কোনো লাভ হবে না এবার। কারণ জনগণ রাস্তায় নেমে গেছে। সার্বিকভাবে ব্যর্থ এই সরকারের পতন অনিবার্য।

জানা গেছে, সরকারের মামলার জালে বন্দি হয়ে পড়েছে সমগ্র বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তৃণমূলের সক্রিয় এমন কোনো নেতা নেই, যার নামে একাধিক মামলা নেই। মামলা থেকে কেউ রেহাই পাননি।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতর শাখা থেকে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ১৫ হাজারের মতো মামলা হয়েছে। এতে আসামি প্রায় ৪০ লাখ। বেশিরভাগ মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে সচল হচ্ছে ওয়ান-ইলেভেন ও পরবর্তী সময়ে সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দুর্নীতির পুরনো মামলা। শুরু হয়েছে বিচারকাজও। অচল, স্থগিত ও নিষ্পত্তিকৃত মামলাগুলোও সচল করা হচ্ছে। নিম্ন আদালতে কভার না করলে সেগুলোকে উচ্চ আদালত ব্যবহারের মাধ্যমেও সাজা বহাল রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে দলটির। অন্যদিকে- হাই কোর্টের জামিনের আদেশ অমান্য করে নিম্ন-আদালতের মাধ্যমে কারান্তরিন রাখা হচ্ছে বিএনপি নেতা-কর্মীদের। এসব মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করে দ্রুত রায় দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা দলটির নেতা ও আইনজীবীদের। সম্প্রতি বিচারিক আদালতে দেওয়া সাবেক দুই মন্ত্রীর ১৩ ও ৯ বছরের সাজা উচ্চ আদালত বহাল রাখায় নেতা-কর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে কিছুটা ভীতি ও আশঙ্কা। এরও আগে একই প্রক্রিয়ায় বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিবকে সাজা দেওয়া হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ড. জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে মামলাও চালু করেছে। দ্রুত রায় দিতে প্রায় প্রতিদিন এ মামলায় সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে। এমনকি রাতেও সাক্ষ্য নেওয়ার নজির স্থাপন করছেন আদালত। অথচ ওয়ান-ইলেভেনের সময় একই ধরনের মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের খালাস দেওয়া হয়েছে।

ওয়ান-ইলেভেনে দায়ের করা মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাবরণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আদালত তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেন। ওই বছর ৩০ অক্টোবর হাই কোর্ট এই সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন।

আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজা হয়েছে সাত বছর। দুই বছরের বেশি কারাভোগের পর সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দন্ডপ্রাপ্ত।

বিএনপি নেতাদের ধারণা, জাতীয় নির্বাচনের আগে অনেক মামলার রায় দেওয়া হতে পারে। তাতে সাজা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মামলার মেরিট নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও আদালত একটা রায় ঘোষণা করে ফেলার পরে তা অমান্য করার সুযোগ থাকে না। তবে দলটির নীতিনির্ধারকদের দাবি, নির্বাচন সামনে রেখে সরকার পুরনো খেলা শুরু করেছে। মামলা ও সাজার ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমাতে চাইছে। কিন্তু সেটি আর সম্ভব নয়। কারণ এবারের আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যুক্ত হয়ে পড়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রশাসন ও আদালতকে ব্যবহার করে সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে। ভবিষ্যতে তা আরও দীর্ঘায়িত করার নীলনকশা তৈরি করছে। এর অংশ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে এসব মামলা। দেড় হাজারের মতো মামলা বাছাই করে আগামী নির্বাচনের আগেই বিএনপি নেতাদের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠাতে চায়। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নির্বাচনে প্রতিপক্ষ ছাড়া খালি মাঠে গোল দেওয়া সহজ হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগকে ব্যবহারের মাধ্যমে স্থগিত মামলাগুলো সচল করে দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একতরফা নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারের মামলা-হামলার এসব কর্মকান্ডে উদ্বিগ্ন নয়, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া বিএনপি। দলটির হাইকমান্ডের মনোযোগ এখন আন্দোলনের দিকে। যদি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় হয় এবং এই সময়ে দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হয়, তখন প্রয়োজনে দলের দ্বিতীয় সারির নেতারা নির্বাচন করবেন। কারণ বিএনপিতে নেতার কোনো অভাব নেই। কেন্দ্রের প্রথম সারি থেকে শুরু করে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যন্ত চার স্তরের নেতাদের দিয়ে এবার আন্দোলন ও নির্বাচনের ছক তৈরি করেছে দলটি। দলীয় হাইকমান্ডও এ ব্যাপারে যথেষ্ট আস্থাশীল রয়েছেন বলে জানা গেছে। দলীয় সূত্র জানায়, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত বিএনপির বিরুদ্ধে করা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা প্রায় ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৪৮১ জন নেতা-কর্মী। আর অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। মোট মামলার মধ্যে ২ হাজার ৮৩০টির বেশি হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এর মধ্যে রয়েছে কয়েক শ গায়েবি মামলাও। ১৯ মে থেকে ৫ জুন পর্যন্ত বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ১৬২টি নতুন মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি ৫ হাজার ৯০০। এ সময় সারা দেশে বিএনপির ৭২০ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৫ দিনে জেলা পর্যায়ে প্রায় সাড়ে ৮০০ নেতা-কর্মীকে জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বলেন, ওয়ান-ইলেভেন ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি নেতাদের নামে করা দুর্নীতির অনেক মামলা বাতিলে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন তারা। উচ্চ আদালত অনেক মামলাই বিচারিক কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। দীর্ঘদিন এসব মামলার বিচারকাজ বন্ধ ছিল।

সেই মামলাগুলো পুনরায় সচল হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুক, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু, সাবেক এমপি হাফিজ ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতি মামলার বিচার চলবে বলে আদেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। তার মামলাটি ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের দুর্নীতি মামলা আগেই সচল হয়েছে। বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ও বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন এ প্রসঙ্গে বলেন, বিরোধী দলকে দমনে সরকার আদালতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু এসবে আর এবার কোনো কাজ হবে বলে মনে হয় না। কারণ জনগণ তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার আদালতে প্রভাব বিস্তার করে সিনিয়র নেতাদের সাজা দিয়ে নির্বাচনের অযোগ্য করতে চাইছে। একই সঙ্গে বিএনপির মাঠপর্যায় এবং সহযোগী সংগঠনের সক্রিয় নেতা-কর্মীদের শাস্তি দিয়ে আন্দোলন স্তিমিত করার কৌশল নিয়েছে। মূলত বিএনপিকে চাপে রাখতে সরকার এসব করছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এখন এ মামলাগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর