মঙ্গলবার, ২০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

সুদহার নিয়ে চাপের মুখে ব্যবসায়ীরা

রুহুল আমিন রাসেল

সুদহার নিয়ে চাপের মুখে ব্যবসায়ীরা

সুদহার সীমা তুলে নেওয়ায় চাপের মুখে পড়তে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ দাবির মুখে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ হয়েছিল। নতুন মুদ্রানীতিতে এ সুদহার সীমা প্রত্যাহার করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে সামগ্রিকভাবে সুদহার বাড়বে। বড় ঋণের তুলনায় ছোট ঋণে সুদ বেশি বাড়বে। ব্যবসার পরিচালন ব্যয়ও বৃদ্ধির আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। 

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাকালে সংকট উত্তোরণে সরকার অনেক প্যাকেজ সুবিধা দিয়েছিল। কিন্তু চলমান ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি করোনার চেয়ে খারাপ। এ পরিস্থিতিতে কোনো প্যাকেজ নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ ও দেশীয় কিছু সংস্থা এবং সমালোচকদের কথায় ঋণ সীমা তুলে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ছোট ব্যবসায়ীরা বেশি বিপদে পড়বেন। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ তুলে নেওয়া উচিত হয়নি। বরং শিল্পায়নের জন্য বড় সমস্যা হবে। এখন একেক ব্যাংক একেক সুদহার নেবে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্টিজ-বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, আলোচিত ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ তুলে নেওয়ায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা চাপের মুখে বেশি পড়বেন। আমার ধারণা, গড়ে দেড় থেকে ২ শতাংশ হারে সুদ বাড়বে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এ সুদহার আরও বেশি বাড়বে। সুদ বাড়লে উৎপাদন খরচও বাড়বে। এতে শিল্প-কারখানা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। জনবল ছাঁটাই হবে। মানুষ চাকরি হারাবেন। এ ছাড়া মুদ্রানীতিতে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ফলে বেসরকারি খাতে অর্থায়ন কমবে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আসছে ?২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বহুল আলোচিত ৯ শতাংশ সুদহার সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে ১৮২ দিনমেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহারের সঙ্গে ৩ শতাংশ সুদ যোগ করতে পারবে ব্যাংক। বর্তমানে সুদহার দাঁড়াবে ১০ শতাংশের মতো। নতুন মুদ্রানীতিতে বাড়ানো হয়েছে নীতি সুদহার। রেপোর সুদ ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ করা হয়েছে। রিভার্স রেপোর সুদ ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমাতে সুদহার বাড়ানোর মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হাসান বলেন, ঋণের ৯ শতাংশ সুদহার সীমা তুলে নেওয়ায় নতুন করে চাপ ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে ব্যবসায়ীদের। এমনিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেশি দিয়েও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রয়াদেশ কমে যাচ্ছে। সুদহার তুলে নেওয়ায় ব্যবসার খরচ বাড়বে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে। নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে আঘাত আসবে। বিনিয়োগের পরিবেশ কমে আসবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-ডিসিসিআই সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তারের মতে, ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণের সুদহারের সীমা ৯ শতাংশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ব্যবস্থার ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের সুদের হার ডাবল ডিজিটে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা বর্তমান বৈশি^ক অস্থির অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। পাশাপাশি এ ধরনের উদ্যোগ বিশেষ করে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি করবে। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আরও বলেন, ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কমিয়ে আনতে কর আহরণের মাত্রা বাড়ানোর ওপর আরও বেশি হারে জোরারোপ করা উচিত। এতে ব্যাংক খাতের ওপর সরকারের নির্ভরতা অনেকাংশে কমবে। আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব। খেলাপি ঋণ বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহকে সংকুচিত করছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন।

বাড়ল ঋণের সুদ কার্যকর ১ জুলাই : কৃষি, এসএমই, ব্যক্তিগত ঋণসহ সব ধরনের ঋণের সুদহার বাড়ছে। কার্যকর হবে ১ জুলাই থেকে। গতকাল এ বিষয়ে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুদহার কত হবে সেটাও সার্কুলারে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সার্কুলারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের বাজার সুদকে ভিত্তি ধরে একটি রেফারেন্স রেট নির্ণয় করা হবে। যা সিক্স মান্থস মোভিং অ্যাভারেজ রেট অফ ট্রেজারি বিল বা স্মার্ট নামে অভিহিত হবে। ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক নির্ণীত স্মার্ট ইনডেক্স প্রতি মাসের প্রথম কর্মদিবসে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ট্রেজারি বিলের সুদহার দেখা গেছে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্মার্টের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ মার্জিন যোগ করলে সুদহার হবে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। সিএমএসএমই ঋণ এবং ভোক্তা ঋণের আওতাধীন পারসোনাল ঋণ ও গাড়ি ক্রয় ঋণের ক্ষেত্রে উল্লিখিত সুদহারের অতিরিক্ত ১ শতাংশ সুপারভিশন চার্জ আরোপ করা হলে সুদের হার দাঁড়াবে ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ। তবে সুপারভিশন চার্জ বছরে একবার আদায় করা যাবে। কৃষি ও পল্লী ঋণের সুদহার হবে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, এ ধরনের ঋণের সুদহার ট্রেজারি বিলের গড় সুদের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি। বর্তমানে কৃষি ঋণে সুদহার ৮ শতাংশ। অন্য ঋণে সুদহার ৯ শতাংশ। আর ক্রেডিট কার্ডে সুদহার আগের মতো ২০ শতাংশ বহাল থাকবে। সার্কুলারে বলা হয়েছে, কোনো সুদ আরোপ করার পর ছয় মাসের মধ্যে তা পরিবর্তন করা যাবে না। এর মধ্যে সুদহার বাড়লেও ব্যাংক গ্রাহকের সুদ বাড়াতে পারবে না। আবার সুদহার কমলেও গ্রাহকের সুদ কমবে না। কোনো ঋণ মেয়াদের আগে সমন্বয় করতে চাইলে সিএমএসএমই ও ভোক্তা ঋণের আওতাধীন ব্যক্তিগত ঋণ এবং গাড়ি ক্রয় ঋণের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ তদারকি মাসুল আনুপাতিক হারে আদায় করতে হবে। ফলে বছরের মাঝখানে কেউ ঋণ শোধ করে দিতে চাইলে তার ঋণের ওপর দশমিক ৫০ শতাংশ হারে তদারকি মাসুল নিতে পারবে ব্যাংক। প্রচলিত ব্যাংকের পাশাপাশি ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোকেও একই নিয়মে মুনাফা হিসাব করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিলে ব্যাংক উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তারপর বাংলাদেশ ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদ বেঁধে দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।

 

 

সর্বশেষ খবর