বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

দুই সিটিতেই নৌকার জয়

রাজশাহীতে নৌকা ১৬০২৯০ ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হাতপাখা ১৩৪৮৩ ভোট - সিলেটে নৌকা ১১৯৯৯১ ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী লাঙ্গল ৫০৮৬২ ভোট

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুই সিটিতেই নৌকার জয়

খুলনা-বরিশালের পর রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচনেও জয় পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বিপুল ভোটে রাজশাহী সিটিতে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন এ এইচ এম খায়রুজ্জমান লিটন ও সিলেটে মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। গতকাল রাতে বেসরকারিভাবে তাদের মেয়র নির্বাচিত ঘোষণা করেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা।

রাজশাহীতে এ এইচ এম খায়রুজ্জমান লিটন নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ১ লাখ ৬০ হাজার ২৯০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলনের মুরশিদ আলম হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছেন ১৩ হাজার ৪৮৩ ভোট। এ সিটিতে ভোটের হার দাঁড়ায় ৫৬.২০ শতাংশ। এদিকে সিলেটে আনোয়ারুজ্জামান নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৯১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল লাঙ্গল প্রতীকে পেয়েছেন ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট। এখানে ভোটের হার ৪৬.৭১ শতাংশ। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া গতকাল রাজশাহী-সিলেট সিটির ভোট গ্রহণ হয়েছে শান্তিপূর্ণ। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলে। ৪টার পরও কিছু কেন্দ্রে ভোটার ছিল। সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা দিনভর ভোট পর্যবেক্ষণ করেন নির্বাচন ভবনে সিসি ক্যামেরায় চোখ রেখে। দুই সিটিতে ভোট হয়েছে ইভিএমে। কিছু কিছু কেন্দ্রে ছিল যান্ত্রিক ত্রুটি। এতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়েছে ভোট দিতে। তা নিয়ে কোনো কোনো ভোটার ক্ষোভও প্রকাশ করেন।

রাজশাহীতে মেয়র হলেন লিটন : রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে আবারও এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের ওপর আস্থা রেখেছে নগরবাসী। লিটন এ নিয়ে তৃতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হলেন। গতকাল রাত ৯টার দিকে রাজশাহীর শিল্পকলা একাডেমিতে স্থাপিত ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী লিটনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন। এ নির্বাচনে মেয়র পদে মোট প্রতিদ্বন্দ্বী চারজন। তার মধ্যে ইসলামী আন্দোলন পরে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেওয়ায় তাদের প্রার্থীর নাম ব্যালটে থেকে যায়। জাকের পার্টির লতিফ আনোয়ার গোলাপ ফুল প্রতীকে ১১ হাজার ৭১৩ ভোট এবং জাতীয় পার্টির সাইফুল ইসলাম স্বপন লাঙ্গল প্রতীকে ১০ হাজার ২৭২ ভোট পেয়েছেন। বড় ধরনের গোলযোগ না হলেও দুটি কেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাত বেঁধেছিল।

ফিরে দেখা রাজশাহী সিটির ফলাফল : ২০১৮ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৯৪ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ধানের শীষ প্রতীকে পান ৭৮ হাজার ৪৯২ ভোট। ২০১৩ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তালা প্রতীক নিয়ে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছিলেন ৮৩ হাজার ৭২৬ ভোট। আর বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন (আনারস) বুলবুল ১ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তালা প্রতীক নিয়ে ৯৮ হাজার ৩৯০ ভোট পেয়ে প্রথমবারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। সেই নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল (বাঘ প্রতীক) পেয়েছিলেন ৭৪ হাজার ৫৫০ ভোট। খায়রুজ্জামান লিটন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও জাতীয় নেতা এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছেলে। তিনি ২০০৮ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মহাজোট সমর্থিত নাগরিক কমিটির মেয়র প্রার্থী হয়ে প্রথমবার জয়লাভ করেন। গতকাল রাতে বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েন। মোড়ে মোড়ে বিজয় মিছিল বের করে নৌকার সমর্থকরা। নগরজুড়ে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন নগরবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি যে অঙ্গীকার করেছি তা জীবন দিয়ে হলেও বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। সিটি করপোরেশন সবার। আমি সবাইকে নিয়ে কাজ করব। আমাদের সবার চেষ্টা রাজশাহীর উন্নয়ন করা। আমরা সেদিকেই মন দিব।

সিলেটে মেয়র হলেন আনোয়ারুজ্জামান : সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। গতকাল রাত সোয়া ৯টার দিকে নগরীর জালাবাদ গ্যাস ভবনের অডিটোরিয়াম স্থাপিত ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামানকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসার ফয়সল কাদের। এ নির্বাচনে মেয়র পদে মোট প্রতিদ্বন্দ্বী আটজন। তার মধ্যে ইসলামী আন্দোলন ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়, যদিও তাদের প্রার্থীর নাম ব্যালটে থেকে যায়। হাতপাখার প্রার্থী মাহমুদুল হাসান ১২ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়েছেন। অন্য প্রার্থীদের মধ্যে শাহ জাহান মিয়া ২৯ হাজার ৬৮৮ (বাস), মোশতাক আহমেদ রউফ ২ হাজার ৯৫৯ (হরিণ), আবদুল হানিফ কুটু ৪ হাজার ২৯৬ (ঘোড়া) , জহিরুল ইসলাম ৩ হাজার ৪০৫ (গোলাপ ফুল), ছালাহ উদ্দিন রিমন (ক্রিকেট ব্যাট) ২ হাজার ৬৪৮ ভোট পেয়েছেন।

ফিরে দেখা সিলেট সিটির ফলাফল : ২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত চারবার নির্বাচন হয়েছে। ২০০৩ সালে প্রথম নির্বাচনে বিজয়ী হন বদর উদ্দিন কামরান, ২০০৮ সালের দ্বিতীয় নির্বাচনেও তিনি কারাগার থেকে মেয়র নির্বাচিত হন। ২০১৩ সাল থেকে মেয়র পদে জয়ী হন বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আরিফুল হক চৌধুরী। তবে এবার তিনি দলের সিদ্ধান্ত মেনে নির্বাচনে প্রার্থী হননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে ৬ হাজার ১৯৬ ভোটে পরাজিত করে মেয়র হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো জয় পান বিএনপির আরিফুল। এ নির্বাচনে আরিফুল পেয়েছেন মোট ৯২ হাজার ৫৮৮ ভোট। কামরান পান ৮৬ হাজার ৩৯২ ভোট। হার ছিল ৬৩ শতাংশের মতো। ২০১৩ সালে এ সিটিতে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৯১ হাজার ৪৬। ক্ষমতাসীন মহাজোট সমর্থিত নাগরিক কমিটির প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে প্রায় ৩৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে মেয়র হন ১৮ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থী কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য এবং সম্মিলিত নাগরিক জোটের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। ভোট পড়ে ৬২ শতাংশ।

২০০৮ সালে নির্বাচনে সিলেট সিটিতে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান আনারস প্রতীকে পেয়েছিলেন ১ লাখ ১৫ হাজার ৪৩৬ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আ ফ ম কামাল পান ৩২ হাজার ৯৭ ভোট ভোট। ভোট পড়ার হার ছিল ৭৫ শতাংশ। এর আগে সিলেটে সকাল ৮টা ২০ মিনিটে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাঠানটুলা শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট দেন। একই ওয়ার্ডের আনন্দ নিকেতন স্কুলে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ভোট দেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাবুল। ভোটদানের পর সকাল ১০টার দিকে বাবুল বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের মারধর করে বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেন। তবে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফয়সল কাদের জানান, এ রকম কোনো অভিযোগ তারা পাননি। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ১৯০টি কেন্দ্রের মধ্যে অর্ধশতাধিক কেন্দ্রে লাঙ্গল প্রতীকের কোনো এজেন্ট ছিলেন না। সব কেন্দ্রে এজেন্টই দিতে পারেনি জাতীয় পার্টি। প্রথমবারের মতো ইভিএমে ভোট দেওয়া নিয়ে ভোটারদের মধ্যে একদিকে যেমন ছিল ব্যাপক উৎসাহ, অন্যদিকে ছিল উদ্বেগ। ইভিএমে পৃথক মেশিনে মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ভোট দিতে গিয়ে অনেকেই বিড়ম্বনায় পড়েন। কেউ কেউ তিনটি পদে ভোট না দিয়ে বুথ থেকে বের হয়ে আসতে চাইলে সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসাররা ভোট সম্পূর্ণ করার জন্য তাদের আবারও বুথে পাঠান। বয়স্ক ও নারী ভোটারদের মধ্যে যারা ইভিএম নিয়ে বিপাকে পড়েন তাদের অন্য ভোটারদের মাধ্যমে সহায়তা করেন ভোট গ্রহণে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা। সিলেট সিটি করপোরেশনের পুরনো ২৭টি ওয়ার্ডের চেয়ে নতুন যুক্ত হওয়া বর্ধিত এলাকার ১৫ ওয়ার্ডে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল বেশি। সকাল থেকে কেন্দ্রগুলোতে ছিল ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। নির্বাচন চলাকালে নগরীতে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির সদস্যরা ছিলেন সতর্ক। প্রতিটি কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ ও আনসার মোতায়েনের পাশাপাশি স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে তৎপর ছিল র‌্যাব ও বিজিবি। প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি করে ভ্রাম্যমাণ আদালত ভোট নির্বিঘ্ন করার দায়িত্বে ছিলেন।

বিজয়ী কাউন্সিলরের বাসায় হামলা : গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে সিলেট সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিজয়ী কাউন্সিলর রেজওয়ান আহমদের বড়বাজারের বাসায় হামলার ঘটনা ঘটে। রেজওয়ান আহমদ অভিযোগ করেন, নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাহেদ সিরাজের লোকজন তার বাসায় হামলা চালায়। হামলা চালিয়ে বাসায় ভাঙচুর করে তারা।  অন্যদিকে রাজশাহীতে গতকাল রাতে বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়েন। মোড়ে মোড়ে বিজয় মিছিল বের করেন নৌকার সমর্থকরা। নগরজুড়ে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে।  নবনির্বাচিত মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন নগরবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি যে অঙ্গীকার করেছি তা জীবন দিয়ে হলেও বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। সিটি করপোরেশন সবার। আমি সবাইকে নিয়ে কাজ করব। আমাদের সবার চেষ্টা রাজশাহীর উন্নয়ন করা। আমরা সেদিকেই মন দেব।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর